স্মরণ-মুক্তির প্রতীক নূর হোসেন by শরাফত হোসেন

১০ নভেম্বর, ১৯৮৭। স্বৈরাচার শাসকের দমননীতির কবল থেকে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার আন্দোলনে লাখো জনতা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে পল্টনের দিকে যাত্রা করে। জিরো পয়েন্টের কাছে দেখা গেল খালি গায়ের এক যুবককে। 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' বুকে-পিঠে লেখা। জীবন্ত পোস্টার হয়ে তিনি রাজপথ কাঁপিয়ে আসছেন।


চোখে-মুখে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা। উপস্থিত জনতার ঘোর কাটার আগেই স্বৈরশাসকের তপ্ত বুলেটে লুটিয়ে পড়েন প্রতিবাদী এ যুবক। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। নূর হোসেনের রক্ত। শহীদ নূর হোসেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেন। শহীদ নূর হোসেন যে গণতন্ত্রের জন্য নিজের জীবন দিয়েছেন, আজও আমরা সেই গণতন্ত্র কি পেয়েছি?
নূর হোসেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও স্মরণীয় নাম। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে রাজধানীর কেন্দ্র, তৎকালীন জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে জীবন দেন অটোরিকশাচালক মুজিবুর রহমানের ২৫-২৬ বছরের সন্তান নূর হোসেন। শহীদ নূর হোসেনের জন্ম ঢাকার নারিন্দায় ১৯৬১ সালে। নিজের বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার বনগ্রামেই বসবাস করে আসছিলেন। তিনি ঢাকার বনগ্রামের রাজাসুন্দরী প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ঢাকার গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ভর্তি হন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর মোটরচালক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ঢাকা মিনিবাস সমিতি চালিত বাসের সুপারভাইজার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু অসচ্ছলতা দূর হয়নি। পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার আগেই দেশের গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে জীবন বিলিয়ে দিলেন এই বীর। বুকে ও পিঠে সাদা রঙের স্লোগান লিখে মিছিলে শামিল হওয়া নূর হোসেনের সেই ছবি আজও আমাদের প্রেরণা দেয়, সাহস জোগায়। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে এসব বীরের অবদান ক্রমশ মলিন হয়ে আসে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের মূল ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সত্যিকার অধিকার আজও অর্জিত হয়নি।
গণতন্ত্রকামী এ বীরের আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানীর জিরো পয়েন্টের নামকরণও হয়েছে নূর হোসেন চত্বর। শহীদ নূর হোসেন সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রকাশ করা হয়েছে স্মারক ডাকটিকিট। প্রতিবছর ১০ নভেম্বর পালন করা হয় নূর হোসেন দিবস। জুরাইন কবরস্থানে নিয়ম করে তাঁর কবরে ফুলও দেওয়া হয়। নূর হোসেন একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস_গণতান্ত্রিক মুক্তিসংগ্রামের, সাহসের, আত্মত্যাগের। আমরা যেন তা ভুলে না যাই।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.