ধর নির্ভয় গান-কী চাহ সমুদ্রসৈকতে? by আলী যাকের

বিজ্ঞান থেকে শিল্পকলা_ সব বিষয়ে এখুনি একটি আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে; যেন বোধ এবং বুদ্ধির আলোকে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি সব মানুষের মধ্যে। সৌন্দর্য, শান্তি, জ্ঞান অথবা সৃজনশীলতার ওপরে কোনো বিশেষ শ্রেণীর বা কতিপয় মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকতে পারে এ আমিবিশ্বাস করি না
সমুদ্রসৈকতে বসে ছিলাম। একা। ঝাউবনের ছায়ায়। অদূরে সৈকত। অনেক বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, এমনকি বৃদ্ধরাও অনন্ত জলরাশি নিয়ে খেলায় মত্ত। ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে, বালুকাবেলার ওপরে। আর তারা লাফিয়ে ওঠে, কি তলিয়ে যায়। তলিয়ে গিয়ে আবার জেগে ওঠে। সেই সঙ্গে শোনা যায় তাদের চিৎকার। এ এক এমন খেলা, যারা খেলছে তারা ছাড়া এর অপার আনন্দ বোঝার আনন্দ বোধকরি আর কারও নেই। আমি নিজেকে এই আনন্দের ভাগীদার করতে পারি না। ছোটবেলায় তো ওদেরই মতো আমিও উন্মত্ত হয়ে সেই অতি প্রত্যুষ থেকে শুরু করে সূর্য ডোবা পর্যন্ত অবিরাম দাপাদাপি করেছি সমুদ্রের ওপরে। মল্লযুদ্ধ করেছি সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে। কৈশোরে কিংবা যৌবনের শুরুতে কতবার এভাবে দাপাদাপি করতে গিয়ে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গরাশি আমায় টেনে নিয়ে গেছে বহুদূর। আবার সাঁতরে ফিরে এসেছি অনেক কষ্টে। বড় ক্লান্ত দেহ নিয়ে বালুকাবেলার ওপরে আছড়ে পড়েছি। ধূলিধূসর শরীর নিয়ে যখন হোটেলে ফিরেছি, মায়ের কিংবা দিদির বকুনি শুনতে হয়েছে। কিন্তু গত ১৫-২০ বছর ধরে আমি লক্ষ্য করেছি, সমুদ্রের জলে নামতে কেমন যেন অনীহা হয়। যেখানে সাগর মিলেছে বালুকাবেলায়, তার থেকে বেশ দূরে, ছায়াঘন ঝাউবনের মাঝে বসে অনন্ত তরঙ্গরাশি তটের ওপরে আছড়ে পড়ে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই দৃশ্য অবলোকন করতে পারি।
আজ এইখানে সাগর পাড়ে বসে আছি। লোকালয় থেকে অনেক দূরে, এমনকি পর্যটকদের হৈচৈ থেকেও। আমাদের এখানে সাধারণত পর্যটনের জায়গাগুলোতে যেসব মানুষ ভিড় করে আসে, তারা কতখানি নিসর্গের আনন্দ সুধা গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি সব হৈচৈয়ের মধ্যেও কিন্তু একাকী হয়ে যেতে পারি। একা নই, কিন্তু একাকী। এ এক অসাধারণ অনুভূতি। আজ সূর্য যখন মধ্যগগনে, আমি এই ঝাউবীথির নিচে বসে তাকিয়ে আছি সেই সাগরেরই দিকে। পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ ঘন হয়ে আসে। বড় আশা এই মেঘ ক্রমে বড় হবে, এরপর হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে ঝড়ের তাণ্ডবে আছড়ে পড়বে সমুদ্রসৈকতে। তখন সবাই চলে যাবে যার যার ঠিকানায়। আমি একা বসে থাকব। কালো মেঘ, উত্তাল জলরাশি, বালুকাবেলার ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করব। মেখে নেব শরীরে ও মনে। এই কল্পনায় এক স্বর্গীয় আনন্দ যেন ছেয়ে ফেলে আমায়। আমি ঝড়ের স্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্ন নয়। কিছুই হচ্ছে না, কিন্তু যেন হচ্ছে। এই আপাত বিপজ্জনক ঝড়ে মানুষ যেন নিজেকে খুঁজে পায়। খুঁজে পায় নিজের শক্তিকে। হঠাৎ চমক ভাঙে সমুদ্রের ধারে জড়ো হওয়া অসংখ্য মানুষের কলকাকলিতে, চিৎকার-চেঁচামেচিতে। আমি আবিষ্কার করি, শান্তি বিষয়টি বোধ হয় এই মুহূর্তে মুখ লুকিয়েছে অভিধানের গভীরে। আমি এই সৈকতে এর আগে একাধিকবার এসেছি। এতবার_যেন এই সাগর, সৈকত আমার পরম বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিবারই আমায় একাকীত্বের খোঁজে আরও একটু দূরে সরে যেতে হয়েছে। ভয় হয়, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই ১০০ কিলোমিটার সৈকতে আর একটি স্থানও থাকবে না, যেখানে মানুষ হানা দেবে না। থাকবে না এমন কোনো জায়গা, যেখানে বসে আমি সাগরের খেলা দেখব আর আমার মন নিত্যই ঘুরে বেড়াবে এখানে-সেখানে। আমি যখন এসব চিন্তা করছি, তখন বারবারই আমার চিন্তাভাবনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মানুষের কণ্ঠের কর্কশ চিৎকারে। আমার হঠাৎ মনে হলো, আমার বয়স অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে নিশ্চয়ই। এই তো স্বাভাবিক। এটা তো সত্য, যারা তরুণ-তরুণী, তারা সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। দেখে নেবে কে হারে কে জেতে। কিন্তু এটাও সত্য যে, প্রতিটি বয়সেরই কিছু নিজস্বতাও আছে, যখন মানুষ ভিন্ন ধরনের কাজ করে আনন্দ লাভ করে। সেই জন্যই আজ এই বালুকাবেলার অদূরে বসে আমি ভাবছি_ আহ! যদি সেই রকম হতো সবকিছু, যেমনটি আমার মন চায়?
আজ আমার মন চাইছে আমি কেবলই শুনি ঢেউয়ের গর্জন আর ঝাউবীথির ওপর দিয়ে শনশন করে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ। আমি ভাবছি এটা কি আদৌ সম্ভব যে, প্রবীণ এবং নবীনের চিন্তাধারা কোনো একটি বিন্দুতে কোনো এক সময় একীভূত হবে? মিলবে কি কল্পনা এবং বাস্তবে? কিংবা শান্তি অন্বেষী আর উত্তেজনার সন্ধানী মানুষেরা? আমার মন ঘুরে বেড়ায় কাছে আর দূরে। আমি ভাবি, হয়তো সব বয়সী মানুষের একটি উপযোগী ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া অতখানি অসম্ভব নয়। অসম্ভব নয় একই চিন্তা নিয়ে, একই ভাবনা নিয়ে একটি অঙ্গনে এসে মেলা। প্রত্যেকের নিজস্বতা নিয়েও কিছু ক্ষেত্রে এক ধরনের সমঝোতা তো সম্ভব হতেই পারে। আমি যখন এসব চিন্তা করছিলাম তখন একজোড়া যুবক-যুবতী দূর থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। শুরুতে ভেবেছিলাম ওরা আমার পাশ দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু কাছে এসে ওরা আমার সামনে দাঁড়াল। আমার অনুমতি নিয়ে বসে পড়ল আমারই সামনে। এরা এদের দলছুট দুটি মানুষ। শুরুতে ভেবেছি, এরা হয়তো আমার অভিনয় দেখে, যেমন সচরাচর হয়ে থাকে, আমার সঙ্গে কথা বলায় আগ্রহী। একটু বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথার সূচনাতেই জানতে পারলাম, ওরা কবিতা পড়তে ভালোবাসে। একটু লাজুক স্বরে দু'জনেই বলল, তারা কবিতা লিখতেও ভালোবাসে। ওরা বস্তুর চেয়ে হৃদয়বৃত্তিকে বেশি মূল্য দেয়। সে জন্য ওরা নিসর্গের শান্তিকে সবার ওপরে স্থান দিতে চায়। শুনে ভালো লাগল। তাই গল্প জমে উঠল। ওরা দুঃখ করে বলল, আমরা শান্তিময় পরিবেশে এসে শান্তিকে ধ্বংস করার ব্যাপারে বড়ই আগ্রহী। ওরা এও বলল, প্রকৃতির এমন সুন্দর ভুবনে বসে সময় নষ্ট না করে একটু গভীর চিন্তা করা হয়তো অনেক বেশি শ্রেয়। ওরা দু'জন আমার চেয়ে অন্ততপক্ষে ৩০ বছরের ছোট হবে। কিন্তু ওদের চিন্তায় এমন একটা কিছু ছিল যার সঙ্গে আমার চিন্তাধারা হয়ে গেল একাত্ম। আমি ওদের আমার একাধিক অভিজ্ঞতার গল্প বললাম। একটি হয়েছিল গ্রিসে এজিয়ান সমুদ্রে ভ্রমণের সময়। এই অক্ষম এক বাঙালি সমুদ্রের ঘন নীল দেখে কবিতাও লিখতে চেয়েছিল। আমি লিখেছিলাম, 'সাগরের এই গাঢ় নীল জলে ইচ্ছে করে কলম ডুবিয়ে নিয়ে এখুনি কবিতা লিখে যেতে...।' আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। এই হাসি ওদের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে দিল। আমি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে, বয়স কিংবা শিক্ষার তোয়াক্কা না করেই, যাদের সৌন্দর্যবোধ এবং প্রকৃতির প্রতি দুর্বলতা একইভাবে নাড়া দেয়। আমাদের এই মুহূর্তে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে এই ধরনের সমমানসিকতার মানুষগুলোর মধ্যে একটা সেতুবন্ধ রচনা করা। যাতে করে নিসর্গ থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান থেকে শিল্পকলা_ সব বিষয়ে এখুনি একটি আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে; যেন বোধ এবং বুদ্ধির আলোকে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি সব মানুষের মধ্যে। সৌন্দর্য, শান্তি, জ্ঞান অথবা সৃজনশীলতার ওপরে কোনো বিশেষ শ্রেণীর বা কতিপয় মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকতে পারে এ আমি বিশ্বাস করি না।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.