সঞ্জীবের ফড়িংডানার বালক by মইনুদ্দীন খালেদ

গর কেবলই আকাশচুম্বী হচ্ছে আর বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে জীবন। দালান যতই মসৃণ, চক্চকে, রঙিন হয়ে উঠছে, ততই প্রকট হয়ে উঠছে তার পাশে শ্রমিকের মলিন রূপ। কোথাও অর্থনীতির মারকুট খেলা চলছে। নগরায়ণ থেমে থাকে না। কে অর্থ জোগান দেয়। জীবনের শিবত্ব কেন ঘুচে যাচ্ছে। মানুষ মানুষকে আর জড়িয়ে ধরছে না। একা হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে একজন অন্যজনকে দেখছে। মধ্যবিত্তও আর সংবেদী নেই। সেও কেবলই অভ্যাসের দাসত্ব করছে।


কোথাও মানুষ বাঁচানোর, সংস্কৃতি বাঁচানোর গভীর কোনো প্রণোদনা নেই। সবই বাণিজ্য। করপোরেটের ছায়ায় ঝিলমিল করছে বুদ্ধিজীবীর সুখ। যত কথা তত অর্থ। কথার কারবারি, শিল্পের নামে দৃষ্টিনন্দন ইমেজ রচনা, একই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করে শিল্পপতিকে তোয়াজে নরম করে তা বিক্রি করা; ভণ্ডামি খলখল করে হাসছে। এসব দেখে যেতে হচ্ছে। দালান উন্নত বিশ্বের মতোই, কিন্তু নগর পূতিগন্ধময়। সেই দালানের পাশে গৃহহীন মানুষ_এই বৈপরীত্যের চাবুকি আঘাত সঞ্জীব দত্ত অনুভব করেন। এ রকম অনুভব করা আজ বোধ হয় গেঁয়ো ব্যাপার। কী সরস কণ্ঠে মাইকের জোরে সরবতর করে বৃদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা বলছেন, 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে যাবে। এটাই নিয়ম।' কিন্তু ফুটপাতে কি মানুষ রাত যাপন করছে না! নগরপ্রান্তে ও রেললাইন ধরে যে ঔপনিবেশিক কাল থেকে চলে আসা মানবেতর বস্তি, তা কি বেড়েই চলছে না? তাহলে জীবনের উন্নতিটা কোথায়? এসব প্রশ্ন ও ভাবনা ঢাকা আর্ট সেন্টারে সমপ্রতি অনুষ্ঠিত সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী 'আমি তুমি সে ইহারা'র বিশ্লেষণে কারো কারো অহেতুক মনে হতে পারে।
কিন্তু এই শিল্পীর প্রধান কাজগুলোতে অর্থনীতির বৈষম্য ইমেজের বিপ্রতীপ উপস্থাপনে স্পষ্টতর হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। মানবমন-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে গভীর বিতর্ক আছে। কিন্তু শিল্প এখনো বস্তু-অভিজ্ঞতানির্ভর। চারপাশের বস্তুপুঞ্জই মনের মধ্যে আন্দোলন আনে। সেই আন্দোলনকে নানা রাগে-রূপে, সুরে-কথায় কাঠে-পাথরে ছেনে ছেনে তবে শিল্প। সঞ্জীব সেই নগরে তাকান। সেখানে স্বপ্নের মতো রঙিন দালান। এই শিল্পী স্বপ্নময়তাকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় দিয়েছেন। দালান তাই যতটা রঙিন, তার চেয়েও রংময় করে চিত্রিত করেছেন তিনি। হঠাৎ মনে হয় স্বপ্নপুরী। কেননা দালানের পাশে ডাস্টবিনে যে পথবালক আবর্জনা কুড়িয়ে বস্তায় ভরছে, সেও রঙিন এবং সবচেয়ে বড় কথা, সেই বালক যেন পাখিবালক, ফড়িংবালক; কেননা তার কাঁধে ডানা আছে পাখিদের মতো। দালান, পথবালক, আবর্জনা_সবই রঙিন হয়ে গেল শিল্পের প্রয়োজনে। সেই টোকাই বালক যেন এলিয়েন বা আগন্তুকের মতো। নগরের সৌধের পাশে সে বিস্ময়। স্বপ্নপুরীর মতো আবহ সৃষ্টি হওয়ার আরো একটি বড় কারণ বাস্তববাদের কানুন গ্রাহ্য করেননি সঞ্জীব। সৌধায়নে তিনি পরাবাস্তবের অচিন নিয়মটাই অবলম্বন করেছেন। তাই কংক্রিট ও ধাতব ইমারতের পাশের বাঁশের বেড়ার বস্তি সবই স্বপি্নল উপাদানেরই অংশ হয়েছে। মলিনতা ও দারিদ্র্যের জর্জর ভাবটা কোনো অনুষঙ্গে লক্ষ করা যায় না। তবে ফেলনা-কুড়ানো বালকের হাতে যে বস্তাটা তা সিমেন্টের। বস্তার গায়ে 'সিমেন্ট' কথাটা ইংরেজিতে লেখা। এই শব্দটা ইমেজের বৈচিত্র্যের পাশে অক্ষর বা টাইপোগ্রাফির মাধ্যমে নগরের রূঢ়তা পরিহাসময় করে রেখেছে। দালানের গায়ে দালানের ছায়া, দালানের গায়ে স্থপতির রৈখিক ডিজাইন_এসবও যোজন করেছেন সঞ্জীব। আর্কিটেকটনিক বাস্তবতাকে তিনি নানাভাবে জাগর রেখেছেন। এসব অনুষঙ্গের সমন্বয়ে ফ্যান্টাসি জমে উঠেছে। হলুদে-ম্যাজেন্টায়-সবুজে আর গোলাপি মিলিয়ে যে কালারস্কিম বা বর্ণজোট দিয়ে ইমেজ অত্যুজ্জ্বল করেছেন সঞ্জীব, তাতে শিল্পীমনের জীবনজগৎ দেখার একটা বিশেষ ভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এই কসমেটিক বর্ণপ্রলেপের আড়ালে জীবনের নিষ্ঠুর সত্য আছে। এটা সেই বৈষম্যের সত্য, যার মুখোমুখি হলে সংবেদী মন দুঃখভার লাঘব করার জন্য কষ্টের হাসি হাসে কিংবা সার্কাসি পোশাক পরে জীবনের কষ্টের দাগগুলো আড়াল করে রাখে। সঞ্জীবের কাজ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে তিনি রঙিন ও সুররিয়ালিজমের আবহ সৃষ্টি করেছেন সমাজের রূপটাকে বিশেষ তীক্ষ্নতা দেওয়ার জন্য। সমাজ নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্য তাঁর এই আয়োজন। তাঁর কাজ প্রথমত দৃষ্টিনন্দন_ চোখকে সুখ দেয়। কিন্তু পরিণামে তা সমাজের সমালোচনা।
সঞ্জীবের কাজে রৈখিক পরিমার্জনার অনুষঙ্গ আর বর্ণপ্রলেপের অনুষঙ্গ মিলে সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। এই পরিমার্জনা আমেরিকা ও ইউরোপের নিও-এঙ্প্রেশনিস্ট ভাষা থেকে সংগৃহীত। সঞ্জীবের আগে এ দেশের অন্য শিল্পীরাও দৃশ্যমান বাস্তবতা যে বহুস্তরী, তা জানান দেওয়ার জন্য এ ধরনের চিত্রগত নিরীক্ষা করেছেন। সঞ্জীবের শিক্ষকরাও সে ভাষায় ছবি আঁকেন। দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে কিভাবে কত বেশি সংঘর্ষের নাটক জমানো যায়, তার প্রয়াস থাকে এ ধারার চিত্রচর্চায়।
'ম্যাজিক কিউব' নামের যে ছবি সঞ্জীব এঁকেছেন, তাতে রাজনীতিসচেতন মনটার প্রত্যক্ষ প্রকাশ লক্ষ করি। ক্ষমতা, চাটুকারিতা, লোভ-লোলুপতা অনেকগুলো চৌকোণাকৃতি স্পেসে ইমেজজুড়ে উপস্থাপিত করেছেন। মানুষের পা, কুকুর, পা চাটা কুকুর, মদের বোতল, ঘাড় মোটা সপ্রিংয়ের চেয়ার, মুকুট_এসব মিলিয়ে সময়ের ম্যাজিক বা ভেল্কি উন্মোচন করেছেন শিল্পী। তবে দালানের পাশে মানুষের অবস্থিতি নিয়ে তাঁর যে ছবি, তা 'ম্যাজিক কিউব'-এর চেয়ে ধারালো ও শিল্পগুণমণ্ডিত।
মানুষ কেন ফড়িংডানা পেল? এ প্রশ্নে যতই কবিতার মতো সুখ থাকুক না কেন, তা আসলে সুখের নয়। তার ফড়িংডানার বড় কারণ তা তার আত্মরক্ষার বর্ম অথবা এই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব একই সঙ্গে ভঙ্গুর, বিপজ্জনক, ক্ষণস্থায়ী, বিসদৃশ। প্রকৃতির মধ্যে হয়তো ডানাঅলা বালক শোভমান, কিন্তু ইমারতের বন্দি নগরমঞ্চে তা অসম্ভব স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই ফড়িংডানার বালক সঞ্জীবের নিজের সৃষ্টি, সে তাঁর স্বরচিত নাটকেরই কুশীলব। এটি একটি চিন্তাগর্ভ শিল্পভাবনা বলে বিবেচনা পেতে পারে। তবে কর্কশ রূঢ়তা নয়, বা রূঢ়তা নির্ভর করেছে কাব্যময়তায়। জীবনানন্দের কবিতাই যেন চিত্ররূপময়তা পেয়েছে। মানবতাহীন সমাজের দিকে তাকিয়েই তো কবির উচ্চারণ :
'যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে
তার হয় নাকো দেখা...'

No comments

Powered by Blogger.