সেলিম আল দীন-কহন কথা ও কবিতা বিকালের কথা by হারুন রশীদ

রৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'আমরা যদি কিছু নাও করতে পারি, তবে মহাকাল আমাদের এই জন্য মনে রাখবে যে, আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি।' কথাটি বাংলা নাটকের গৌড়জন সেলিম আল দীনের কাছ থেকে শোনা। এখন তাঁর সম্পর্কেও যদি একই কথা উচ্চারিত হয়, সেটি কি ভুল হবে? হয়তো হবে, হয়তো না।


সেলিম আল দীন এমনই এক ঈর্ষণীয়, মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে তাঁর সানি্নধ্য পাওয়াটা ছিল সত্যি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। বিশেষত আমরা যারা তরুণ, তাদের জন্য ছিল এটি এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আমরা নিঃসন্দেহে সেই দুর্লভ সানি্নধ্য পাওয়ার গৌরবের অধিকারী। যদি একটি ঝরাপাতাও প্রশ্ন করে, একজীবনে কী পেয়েছ? উত্তরে বলব, সেলিম আল দীন_এই পুষ্পিত নাম। আপাদমস্তক এক সৃজনশীল মানুষ। তিনি নিজেই যেমনটি বলেছেন, 'এই আকাশ-সম্ভূত সূর্যের নিচে আমি নিত্যই সৃষ্টিশীল এবং অনিঃশেষ জীবনপালার অংশীদার, এই বিশ্বাস আমাকে অহংকারী করে।'
আমরা বিশেষত শামীম রেজা, হামীম কামরুল হক, আসাদ আহমেদ, রনজু রাইমসহ একগুচ্ছ সৃজনশীল তারুণ্য তাঁকে পেয়েছিলাম নানা রূপে_কখনো শিক্ষক, পিতা, বন্ধু কিংবা তারও অধিকতর কিছু। বয়স, পদ-পদবি, খ্যাতি_কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আমাদের সম্পর্কে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, শামীম রেজার আগ্রহেই আমরা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। শামীম বরিশালের ছেলে। জীবনানন্দীয় একটা ভাব ছিল ওর মধ্যে। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি আগ্রহ। ফার্স্ট ইয়ারেই মোটা মোটা বই হাতে নিয়ে ঘুরত। তার মধ্যে সতীনাথ ভাদুরীর 'ঢোড়াই চরিত মানস' কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা'জাতীয় বইও থাকত। শামীম স্যারকে নাটকের কবি বলতেন। স্যারও এতে যারপরনাই খুশি হতেন। কারণ লেখক হিসেবে তিনি কোনো শ্রেণীবিভাজন মানতেন না। তিনি ছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। তাঁর ভাষায়, 'আমি চাই আমার লেখাগুলো গল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি অভিধা ভেঙে অন্য সব শিল্পতীর্থগামী হোক।'
সৃজনশীল মাধ্যাকর্ষণ এক শক্তিতে আমরা বাধা পড়েছিলাম। একটা লেখা শেষ হয়েছে, অমনি ডাক পড়ত আমাদের। পড়ে শোনাবেন। মতামত জানতে চাইবেন। যেমনটি তিনি নিজেই লিখেছেন তাঁর লেখা 'প্রাচ্য' কথানাট্যের ভূমিকায়_"রচনা শেষে 'প্রাচ্য'র পাঠ নিমিত্ত আমি আমার অনুবর্তী তরুণ কবি শামীম রেজা, আসাদ, হারুন রশীদসহ মানিকগঞ্জ শহরে আসাদদের গৃহে গমন করি। যাবার পথে সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রসংগীত, সেই সায়াহ্নে আমার মনে বিশ্বপ্রেমের আলিম্পনা। রাত ১০টা থেকে আসাদদের পরিবারের সবাকার নিদ্রা হরণপূর্বক ভোর পর্যন্ত আমি 'প্রাচ্য' পাঠ করি। আরক্ত চোখ সঙ্গীদের, চলে যাই প্রিয় নদী কালীগঙ্গা। হাঁটুজলে সমুদ্রস্নান। হঠাৎ একটা বানানো জলস্তব শুরু করি আমি_কবিগণ নদীবন্দনা উচ্চারে আমার সঙ্গে। এ বেদনাবৃত কাহিনী শেষে জলজাত হুল্লোড়। এও বোধ হয় প্রাচ্যমানস কিংবা সর্বোতভাবে মানব চরিত্রের বৈপরীত্য।" (প্রাচ্যর ভূমিকা, শ্রাবণ প্রকাশনী, ১৬ জানুয়ারি ২০০০)
ভালো কিছু রান্না করা হয়েছে, খেয়ে যেতে হবে। এমনই অসংখ্য আবদার, অনুরোধ, আদেশ, নির্দেশ, অভিমান_সবই চলত তাঁর সঙ্গে। কী অজানা ঘোরের মধ্যে কখন যে এক যুগেরও বেশি সময় তাঁর সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা টের পাইনি। কখনো তাঁর নতুন লেখা কপি করতে হয়েছে। তাঁর লেখা নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে যেতে হয়েছে। ভোজনরসিক মানুষটির সঙ্গে বাজারে যেতে হয়েছে ভোরবেলা উঠে। সেদিন হয়তো হলে ফেরাই হয়নি। গ্রাম ছিল তাঁর পছন্দের জায়গা। কতবার কত জায়গায় তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হয়েছি_কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সখীপুরে গিয়ে সেখানকার 'মান্দাই' নামক এক অখ্যাত নৃ-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে প্রথমে প্রবন্ধ লিখলেন দৈনিক বাংলায়। তারপর 'বনপাংশুল' নামে এক মহাকাব্যিক উপাখ্যানই লিখলেন এই জনগোষ্ঠীর জীবনকে ঘিরে। এভাবে এক অখ্যাত ক্ষয়িষ্ণু নৃ-গোষ্ঠীকে তুলে আনলেন বইয়ের পৃষ্ঠায়, ঢাকার মঞ্চে পাদপ্রদীপের নিচে। তার পর থেকে সখীপুরের প্রেমে পড়ে গেলেন। সেই সঙ্গে মান্দাইদেরও অনেকবার তিনি সখীপুরে গেছেন। রাত কাটিয়েছেন। সখীপুরের তাঁর আরেক কৃতিমান ছাত্র অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান, এর নামে 'বনপাংশুল'-এর একটি চরিত্রের নামই রাখলেন। কারণ সখীপুরে ড. লুৎফর রহমানের শ্বশুরবাড়ি কালিদাস গ্রামের মান্দাইদের জীবনাচরণ দেখে তিনি তাদের নিয়ে 'বনপাংশুল' নাটকটি লিখতে উৎসাহী হন। আর এ জন্য আমাকেও উৎসাহী করেন এই নৃ-গোষ্ঠীর মিথ (সুঃয) ও জরঃঁধষ নিয়ে পিএইচডি করার জন্য। তাঁর নির্দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই তাঁরই তত্ত্বাবধানে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে। দেখা করতে গেলেই বলতেন, 'আমি থাকতে থাকতেই ডিগ্রিটা নিয়ে নে।' বলতাম, 'কী যে বলেন, স্যার! আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি? আপনাকে অনেক দিন বাঁচতে হবে। বাংলা নাটকের অনেক কাজ আপনার হাত দিয়ে হয়েছে। আরো অনেক কিছু দিতে হবে। আমাদের মতো অনেক ছাত্রকে পিএইচডি দিতে হবে। তার আগে কোথায় যাবেন আপনি?'
পিএইচডির একটি চ্যাপ্টার স্যারকে দেখালে খুব খুশি হলেন। প্রায় এক পৃষ্ঠা নতুন করে লিখে দিলেন। আদিবাসীদের নিয়ে এমন একটি লাইন লিখলেন_'তারা আমাদের থেকে অন্য হতে পারে, কিন্তু ভিন্ন নয়।' তারপর বললেন, 'দেখলি তো এভাবে ভাষার সৌকর্য বাড়াতে হয়। লেখার এক জায়গায় 'পুরানপ্রোক্ত' শব্দটি যোগ করে বললেন, 'এভাবে শব্দভাণ্ডার বাড়াবি। লেখাকে একটা স্ট্যান্ডার্ডে দাঁড় করাবি।' থিসিসের প্রথম চ্যাপ্টার নিয়ে সেমিনার করতে বললেন। 'প্রথমটা দেখলেই বোঝা যাবে বাকিগুলোতে কী করবি'_এমনটিও বললেন। কিন্তু সেই সেমিনার করার সময়টুকুও তিনি দিলেন না।
টিএসসির পরিচালক থাকার সময় নানা রকম অনুষ্ঠান করতে শুরু করলেন। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া কবিতা বিকালের প্রথম পর্বের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি তরুণ কবিদের উদ্দেশে বললেন, 'কবিতা হৃদয়ানুভূতির নির্যাস। আত্মক্ষরণের তো বটেই, আত্ম-আবিষ্কারেরও_এ কথা সকলকে মনে রাখতে হবে।' তিনি আরো বললেন, 'কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক_যা-ই বলি না কেন, সবই আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। কবিতা বিকাশকে আরো ব্যাপ্তি দেয়। আত্মপ্রকাশ না করলে কেউ স্বনির্ভর হয় না। তাই তরুণদের প্রকাশমুখিনতার বাহন হিসেবে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অতীব জরুরি।'
'কহন কথা' নামে একটি গানের দল করলেন আমাদের নিয়ে। সাবেরা তাবাসসুম টফি, কাজী শুসমিন আফসানা শিমু, সাকিরা পারভীন সুমা, শশী, মামুন আব্দুল্লাহসহ অনেককেই তিনি কহন কথার আসরে ডাকলেন। দলের জন্য পিয়ানো কিনতে হবে। আমাদের নিয়ে দল বেঁধে ছুটলেন ঢাকায়। নিজে গান লিখলেন, তাতে সুর বসালেন। আমাদের মতো অসুরদের দিয়ে তা অনেক অনুষ্ঠানে গাওয়ালেন। তাঁর সময় নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠানে সরগরম হয়ে থাকত টিএসসিসহ পুরো ক্যাম্পাস।
মহুয়াতলায় শুরু করলেন 'মহুয়া ফোটার উৎসব'। এই উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন জাবির তৎকালীন উপাচার্য (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। কহন কথার শিল্পীদের পরিবেশনার পর মঞ্চে উঠলেন দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী। মহুয়া ফুলের মাতাল করা গন্ধ আর দর্শক-শ্রোতার বিপুল সাড়া পেয়ে সঞ্জীবদাও মঞ্চ থেকে নামতে চাইছিলেন না। হায়, সেই সঞ্জীবদাও আজ কোন নক্ষত্রলোকে হারিয়ে গেলেন!
স্যারের সঙ্গে যখন গাড়িতে কোথাও যেতাম, শান্তিদেব ঘোষ, পীযূষ কান্তি আচার্যের কণ্ঠে 'গানে গানে তব বন্ধনও যাক টুটে'_এই রবীন্দ্রসংগীতটি বাজাতে বাজাতে বলতেন, 'সুর ছাড়া প্রাণ ভীষণ বাধা। সারাক্ষণ সুরের মধ্যে থাকবি।' রবীন্দ্রনাথের প্রতি এমনই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'যদি নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথকে এক কাপ চা তুলে দিতে পারতাম, তাহলে জীবনে লিখতাম না।' আরো বলতেন, 'বেশি করে রবীন্দ্রনাথ পড়বি। নিজেকে তৈরি করার জন্য এর চেয়ে মহৌষধ আর নেই।'
ফেনীর সেনাগাজী থানার সেনেরখীলে তাঁর নিজ গ্রামের বাড়িতে একবার বেড়াতে গেলেন আমাদের নিয়ে। সঙ্গে পারুল ভাবি। স্যারের মনে সংশয় ছিল, যদি যেতে রাজি না হই। বললেন, 'চল না, আমার যদি ছেলেসন্তান থাকত তাহলে এভাবে বলতাম না। আমি বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই। স্যারের কথায় কেঁদে ফেলি। পিতামাতাহীন আমার হৃদয়টাও আর্দ্র হয়ে ওঠে। মনে হয় পিতার অবর্তমানে আরেক পিতা হাত ধরে ডাকছেন। এমন ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায়? পারুল ভাবি আমাদের আরেক মা। ঈদে তাঁদের সঙ্গে যাব, তাই আড়ং থেকে আমাদের জামাকাপড় কিনে দিলেন। যাক সে কথা। গেলাম স্যারের গ্রামের বাড়িতে। আমি আর সানি ভাই গল্পসল্প করে মধ্যরাতে শুয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ পরই স্যারের ডাক, 'এই, তোরা ওঠ। প্রকৃতি থেকে পাঠ গ্রহণ কর।' না উঠে উপায় কী। শীতের কুয়াশা এমনই যে একটু দূরেও দেখা যায় না। তার মধ্যে স্যার বললেন, 'চল, হাঁটি।' আমরা হাঁটতে লাগলাম। স্যার বললেন, 'আমার সঙ্গে গান ধর_'আকাশ ভরা সূর্যতারা বিশ্ব ভরা প্রাণ/তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাটায় ভুবন দোলে নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান/বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান
মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখার ক্ষমতা কেবল রবীন্দ্রনাথের মতো লেখকের পক্ষেই সম্ভব_কুয়াশার ভেতর অস্ফুট তারা দেখিয়ে স্যার আরো বললেন, 'ওই যে আকাশে নক্ষত্র আর মাটিতে আমরা_সবই, সব কিছুর সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা।' আসলেই তো আমরা একসূত্রে গাঁথা, স্যার যতই জাহাঙ্গীরনগরের স্বচ্ছ লেক আর লাল মাটিতে লতাগুল্মে ভরা ক্যাম্পাসে কবরের নিচে ঘুমান না কেন। তাইতো চোখের জলের গাঙে কোনো শোকগাথা নয়, সেনেরখীলের আকাশের সেই সব তারা তো সব আকাশেই ওঠে। তাই যেখানেই যাই, সঙ্গে থাকেন সেলিম আল দীন_অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে।

No comments

Powered by Blogger.