মিডিয়া ভাবনা-সুস্থ রাজনীতির লক্ষ্যে তরুণদের সংঘবদ্ধ হতে হবে by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার যুবকদের এক সম্মেলনে সম্প্রতি আবার উচ্চারিত হয়েছে: ‘বাংলাদেশের তরুণেরা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়। তারা দেশের মেইনস্ট্রিম রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি দেখে হতাশ। তারা এখন আর দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হতে চায় না।’ (ডেইলি স্টার, ৮ জানুয়ারি) কথাগুলো যে একেবারে নতুন তা নয়। নানা জরিপ বা লেখালেখিতে গত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের কথা শোনা গেছে।


এই মনোভাব বাংলাদেশের বেশির ভাগ তরুণের মনোভাব কি না তা বলা দুরূহ। তবে সাধারণভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশের বর্তমানকালের তরুণেরা (১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী) রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী নয়। ব্যতিক্রম খুব কম। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক দলের আমলে গত ২০ বছর এ দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে প্রায় দুই দশক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা তাঁদের গণতান্ত্রিক ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে দুইবার করে সরকার গঠন করেছেন। কিন্তু ছাত্রদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে সেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেননি।
বর্তমানকালের ছাত্রসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা এতই মেরুদণ্ডহীন ও আপসকামী যে তাঁরা তাঁদের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য গত ২০ বছর কোনো সংগ্রাম করেননি। এই ছাত্রনেতারা দেশের মানুষের জন্য কী সংগ্রাম করবেন, নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যই তো সংগ্রাম করতে পারেননি। দুর্নীতি, টেন্ডার, ব্যবসা, সন্ত্রাস ইত্যাদিতে আপাদমস্তক নিমজ্জিত বেশির ভাগ ছাত্রনেতাই আজ এক অদ্ভুত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই নাকি ছাত্রই নন। অনেকে বিবাহিত, সন্তানের জনক। ব্যবসা-বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি করে ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন! (সূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্র)
এ ধরনের ছাত্রসংগঠন বা ছাত্রনেতারা চোখের সামনে থাকলে কোনো শিক্ষিত, রুচিবান, নীতিবোধসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান ছাত্রের পক্ষে ছাত্ররাজনীতি করা সম্ভব নয়। কাজেই অনেক ছাত্র যে রাজনীতিবিমুখ হয়েছে এ জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আমরা যখন ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম (১৯৬৬-১৯৭৪) তখন আমাদের নেতারা ছিলেন আদর্শ। শুধু আমাদের নয়, সারা দেশের আদর্শ। ১৯৬৮-৬৯ সালে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা দেশে যে গণ-আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সেই আন্দোলনে আইয়ুব খানের মতো একজন স্বৈরাচারী সামরিক শাসকের সরকারের পতন ঘটেছিল। এখনকার সব ছাত্র, দল ও নেতা মিলে আন্দোলনের মাধ্যমে একজন স্বেচ্ছাচারী ভিসিকেও পদচ্যুত করতে পারবে কি না সন্দেহ। টেন্ডারবাজ নেতাদের পক্ষে আন্দোলন করার নৈতিক জোর থাকে না। সে জন্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে গত ২০ বছর কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। কোনো নতুন নেতা বা নতুন প্রতিভার উন্মেষও ঘটেনি। প্রতিযোগিতার (নির্বাচন) ভিত্তিতে কোনো নেতৃত্ব আসেনি। যেসব ছাত্রনেতাকে আমরা দেখছি তাঁরা প্রায় সবাই বড় দুই দলের লেজুড়বৃত্তির জন্যই নেতার পদ পেয়েছেন। ছাত্রদের সমর্থনে নয়।
এসব কথা মোটেও নতুন নয়। তবু বর্তমান তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রনেতা ও ছাত্ররাজনীতির একটা রূপরেখা তুলে ধরা হলো আমার বর্তমান আলোচনার সুবিধার্থে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় দেশের তরুণদের সম্মেলনে তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। অন্য দেশ নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি না। আমাদের বিষয় বাংলাদেশের তরুণ।
‘বাংলাদেশের তরুণদের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তারা অনেক প্রতিভাবান। তথ্যপ্রযুক্তি তাদের হাতের মুঠোয়। তারা চাইলে দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে।’ এ ধরনের আপ্তবাক্য প্রায়ই সভা-সেমিনারে শোনা যায়। কিন্তু এ কথা কোনো বক্তা বলেন না যে সাংঘর্ষিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে বজায় থাকলে প্রতিভাবান তরুণদের পক্ষে দেশের নৃেতত্ব দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রতিভাবান তরুণেরা বর্তমান বড় দুই দলের প্রতি বিমুখ। দুই নেত্রীর প্রতিও বিমুখ। কিন্তু বড় দুই দলই তো দেশে ঘুরেফিরে দেশ শাসন করছে। ভবিষ্যতেও করবে। এই দুই দল কি প্রতিভাবান তরুণদের মূল্যায়ন করবে? যে দুই দল সরকারি প্রশাসনের প্রায় ৭০ ভাগ রাজনীতিকরণ করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষক নিয়োগকে দলীয় ভিত্তিতে বিন্যাস করে, তাদের হাতে তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে? প্রতিভাবান তরুণদের মূল্যায়ন হবে?
আমার ধারণা, হবে না; যদি বড় দুই দলের নেতৃত্বের মধ্যে কোনো গুণগত পরিবর্তন না ঘটে। সেই সম্ভাবনাও আমি দেখি না। তাই আমি কয়েক মাস আগে প্রথম আলোয় এক নিবন্ধে প্রস্তাব করেছিলাম, দেশপ্রেমিক তরুণদের প্রথমে একটি ফোরামে, পরে তা একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করার লক্ষ্যে এখনই সংঘবদ্ধ হওয়া উচিত। যেসব তরুণ দেশের গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে চায়; অগণতান্ত্রিক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশ, হরতাল, দুর্নীতি, প্রশাসন দলীয়করণ, কুশাসন, বিচার বিভাগের দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দলীয়করণ থেকে মুক্তি চায় তাদের উচিত এখনই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা এলাকাভিত্তিক বা জেলা-উপজেলা ভিত্তিক ফোরাম গঠন করে দেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা। এই আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই তরুণেরা তাদের করণীয় নানা পন্থা বের করতে পারবে। আজকের তরুণেরা অনেক বেশি প্রতিভাবান ও দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে অবহিত। এ ব্যাপারে ইন্টারনেট, ব্লগ ইত্যাদি প্রযুক্তিকেও তারা কাজে লাগাতে পারবে।
শুধু সেমিনার, শুধু আশার বাণী, শুধু কথার মালা গেঁথে চললে তরুণদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তরুণদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। নতুন রাজনীতি করার লক্ষ্যেই সংঘবদ্ধ হতে হবে। এখানে যেন কোনো লুকোচুরি করা না হয়। প্রতিভাবান ও দেশপ্রেমিক তরুণদের এটা উপলব্ধি করতে হবে, এই দেশেই তাদের থাকতে হবে। কাজেই এই দেশের রাজনীতি, সরকার, জাতীয় সংসদ, প্রশাসন, বিরোধী দল—সব ক্ষেত্রেই তাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। অংশগ্রহণের জন্য নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। আজকের প্রতিভাবান তরুণেরা যদি তাদের বয়স ৪০-এর কোঠায় যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে যেতে না পারে, মন্ত্রী হতে না পারে, প্রধানমন্ত্রী হতে না পারে, তাহলে এই দেশটা কোথায় নিক্ষিপ্ত হবে তা কি তারা অনুমান করতে পারছে?
দেশের বড় দুটি দলের হাতে যদি আরও ২০ বছর ক্ষমতা থেকে যায় তাহলে দুই পরিবারের উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতায় বসবে। অন্য কেউ নয়। এই ‘রাজতন্ত্র’ কি বর্তমান তরুণেরা মেনে নিতে প্রস্তুত? যারা এ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কলুষিত করেছে, শুধু ভোটের জোরে তারা বংশানুক্রমে দেশ শাসন করে যাবে—তা কি তরুণেরা মেনে নিতে রাজি? এই ভোটের জোরও নানা ফন্দিফিকিরে কলুষিত।
‘ভোটের জোর’ কথাটার ওপর আমি খুব গুরুত্ব দিতে চাই। দেশ পরিচালনা করার সুযোগ আজকের তরুণেরা তখনই পাবে যখন তারা সুষ্ঠুভাবে ভোটের জোর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। দূষিত রাজনীতির উত্তরাধিকারদের ভোটের জোরে পরাভূত করতে হলে এখন থেকে সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। সংগঠন ও কর্মসূচি ছাড়া ভোট পাওয়া যাবে না। আজকের তরুণেরা যখন দেশ পরিচালনা করবে তখন তাদের লক্ষ্য ও কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে এখন থেকেই গবেষণা ও মতবিনিময় শুরু করা উচিত।
অনেক তরুণ বিদেশে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এটা খারাপ কিছু নয়। বিদেশে গিয়ে ভালো উপার্জন করে দেশে টাকা পাঠালে দেশেরই উপকার হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের যে রকম জনসংখ্যা তা মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিছু তরুণ বৈধভাবে বিদেশে গিয়ে আয়-উপার্জন করলে তা দেশের জন্য নানা দিক থেকেই মঙ্গল।
কিন্তু সব তরুণ তো আর বিদেশে যাবে না বা যেতে পারবে না। কাজেই তারা দেশেই থাকবে। দেশের ভবিষ্যৎ ও তাদের ভবিষ্যৎ এক সুতায় বাঁধা। কাজেই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, জাতীয় সংসদ, সরকার, নীতিনির্ধারক—সবকিছুর ওপর যাতে আজকের প্রতিভাবান তরুণেরা যুক্ত হতে পারে তার চেষ্টা এখনই শুরু করা উচিত।
তরুণদের নিয়ে মাঝেমধ্যে সভা-সেমিনার হয়। এ ধরনের সভায় তরুণদের সুস্থ রাজনীতি শুরু করার জন্য আবেদন কেউ সাধারণত করে না। অথচ এটাই হওয়া উচিত আসল কথা। কারণ দূষিত রাজনীতির কাছে তরুণদের ছেড়ে দিলে তারা ভালো কিছু করতে পারবে না। দুর্নীতির কাছে, সন্ত্রাসের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। তারা চাইলেও বড় এন্টারপ্রেনর হতে পারবে না। কারণ দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত সরকার তাদের পদে পদে বাধা দেবে। কাজেই তরুণদের কোনো আহ্বান জানানোর সময় মনে রাখতে হবে, কোন ধরনের দেশ, রাজনীতি ও সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমরা তাদের আহ্বান জানাচ্ছি।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় যুবকদের সম্মেলনেও মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে তরুণদের উদ্দেশে অনেক কথা বলা হয়েছে। যা শুধু কথার কথা বা শব্দের জাল বিস্তার মাত্র। এ ধরনের ফাঁকা কথার প্রলোভনে যেন তরুণেরা বিভ্রান্ত না হয়। মূলকথা হলো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি। রাজনীতি ঠিক করতে পারলে ব্যবসাও হবে, উন্নতিও হবে। বড় দুই দল যখন ‘প্রতিজ্ঞা’ করেছে তারা এই অপরাজনীতি চালিয়ে যাবে, তখন তরুণদেরই উচিত হবে দেশে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক (প্রকৃত) রাজনীতির সূচনা করা। কারণ এ দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে। ভবিষ্যৎ যদি তারা ভালো দেখতে চায় তাহলে রাজনীতিকে ঠিক করতে হবে সবার আগে।
বর্তমান সময়ের মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ফোরামগুলো অনেক চেষ্টা করেছে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য। কিন্তু তাৎপর্যময় কোনো পরিবর্তন আনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে তারা যে চেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে, এ জন্য তারা অভিনন্দন দাবি করতে পারে।
বর্তমান তরুণ সমাজ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে, তা নিয়ে এখনই মতবিনিময় শুরু করুন। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে অপরাজনীতি থেকে মুক্তির পথ। এই পথের সন্ধান পেতেই হবে, না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.