চারদিক-হাতিয়া মডেল স্কুলের ১০০ বছর

মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ১০০ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে একটি বিদ্যালয়। শতবর্ষের অর্জন বিদ্যালয়টিকে যেমন দিয়েছে গরিমা, তেমনি এই দ্বীপের শত সহস্র মানুষের মনের মণিকোঠায় জ্বালিয়ে দিয়েছে মানবিক মহিমার হিরণ্ময় দ্যুতি। আজ এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে এবং ছড়িয়ে আছে বিশ্বময় নানা পেশায়, নানা কর্মকাণ্ডে। অনেকেই তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে রেখেছেন কৃতিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর।


এই বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয়েছে এমন ছাত্র আজ যেমন উচ্চতর শিক্ষা গবেষণায় অবদান রাখছেন, তেমনি এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা আছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে উপযুক্ত মানবসম্পদ বিনির্মাণের কর্মযজ্ঞে। এমনকি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের পঙিক্ততে গৌরবময় স্থান অলংকৃত করে আছেন এই বিদ্যালয়ের কীর্তিমান শিক্ষার্থী। এই সূত্রে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্লাজমা পদার্থ বিজ্ঞানী মফিজুর রহমানের নাম উল্লেখ করতে চাই, যিনি ইতালির বিজ্ঞান সমিতির অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্মানিত স্থান অলংকৃত করে আছেন।
হাতিয়া দ্বীপের এই প্রাচীনতম বিদ্যালয়ে যেসব শ্রদ্ধেয় মানুষ শিক্ষকতায় আত্মনিবেদন করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন প্রকৃত বিচারে জাগতিক লোভমুক্ত, সদাচারী আর মানুষ গড়ার প্রত্যয়ী এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক। এমন অনেক শিক্ষকের মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে প্রয়াত মোছায়েফ উদ্দিন বিএসসি স্যারের নাম উল্লেখ করছি, যিনি ছিলেন সব সময় একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষক। তাঁর সময়ের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক প্রাগ্রসর। ষাটের দশকের শেষার্ধেই তিনি ছাত্রদের কম্পিউটার বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। হেড মাস্টার আবদুল মোতালেব (বিএবিটি) স্যার বিংশ শতকের বিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল সত্ত্বেও মাটির টানে হাতিয়া মডেল হাইস্কুলের শিক্ষকতাকেই জীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুদীর্ঘ সময় এই স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর অসাধারণ শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতা আজও এই অঞ্চলে কিংবদন্তি হয়ে আছে।
ষাটের দশকের উত্তাল গণ-আন্দোলনের ঢেউ হাতিয়ার বুকেও আছড়ে পড়ে। তদানীন্তন রাজনৈতিক আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনে এই বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
হাতিয়ার অকুতোভয় মুক্তিসেনাদের সিংহভাগই ছিলেন এই বিদ্যাপীঠের সাবেক ছাত্র। এই বিদ্যালয়ের চারজন ছাত্র যথাক্রমে শহীদ মোস্তফা আলী দুলাল, শহীদ জামাল উদ্দিন, শহীদ আলাউদ্দিন ও শহীদ অলিউদ্দিন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানের অবিস্মরণীয় গৌরব অর্জন করেন।
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাতিয়া গিয়েছিলেন। আবার স্বাধীনতা-উত্তর দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি হাতিয়া সফর করেছিলেন। দুবার তিনি হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল হাইস্কুল মাঠে বক্তব্য দেন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও হাতিয়ায় যাওয়ার পর এই বিদ্যালয়ের মাঠে বক্তব্য দিয়েছিলেন। নানাভাবে বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই স্কুলটির নাম জড়িয়ে আছে।
প্রকৃতির স্নেহধন্য এবং অবারিত ঐশ্বর্যের আকর হাতিয়া দ্বীপ। প্রায় দুই হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটি প্রাকৃতিকভাবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও জ্ঞান অন্বেষা ও শিক্ষার প্রতি অনুরাগের কারণে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ এবং সেই সূত্রে বিশ্বের সঙ্গে। এই বিচ্ছিন্ন জনপদে হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল হাইস্কুলের ভূমিকা যেন প্রকৃত ধাত্রীর মতো।
১৩ জানুয়ারি শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন দেশের বরেণ্য কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। এই বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনবিদ, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠানটি পরিণত হবে এক মহা মিলনমেলায়।
দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালায় থাকবে সাবেক শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণা, বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা আর হাতিয়া দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী আকর্ষণীয় রকমারী পিঠা উৎসব এবং বিজ্ঞান মেলা। এই মেলায় অত্যাধুনিক শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে ছাত্রছাত্রী ও উৎসাহী সবার পরিচয় ঘটানো হবে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করবেন এ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র কীর্তিমান বিজ্ঞানী অধ্যাপক মফিজুর রহমান। সবার অংশগ্রহণে ও নানা আনুষ্ঠানিকতায় এই দুই দিনের উৎসব হয়ে উঠবে প্রাণচঞ্চল ও আনন্দঘন।
আশ্রাফ উদ্দিন

No comments

Powered by Blogger.