ধর্ম-তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

জতেমা’ আরবি শব্দ; এর অর্থ হচ্ছে সমাবেশ বা সম্মেলন। ধর্মীয় কোনো কাজে বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রিত করাকে ইসলামের পরিভাষায় ইজতেমা বলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর বহুসংখ্যক দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা যেখানে সমবেত হন তাকে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ বলা হয়।
নবী করিম (সা.)-এর চিরশাশ্বত মুখনিঃসৃত অমিয় বাণী: ‘তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’—একে আঁকড়ে ধরে সারা বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলিগ ও ইসলামি দাওয়াহ অনুসারী দ্বীনদার মুসলমান বাংলাদেশের রাজধানীর উপকণ্ঠে কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমায় মিলিত হন।
তাবলিগ অর্থ প্রচার করা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, আহ্বান করা প্রভৃতি। একজনের অর্জিত জ্ঞান নিজ বা সম্মিলিত ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নামই তাবলিগ। কোনো আদর্শ বা বিশেষ মতবাদের প্রচারকাজকে তাবলিগ বলা হয়। সাধারণত ধর্মীয় মতবাদ প্রচারই তাবলিগ। পৃথিবীর বুকে ইসলামের অভ্যুদয়, ক্রমবিকাশের অগ্রযাত্রা ও প্রচার-প্রসারের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো দাওয়াত ও তাবলিগ। ইসলামের আবির্ভাবের মুহূর্ত থেকে অদ্যাবধি নিরলস, নিরবচ্ছিন্ন গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে এর কার্যক্রম। প্রকৃতপক্ষে দাওয়াত ও তাবলিগ হচ্ছে ইসলামের একটি মৌলিক কর্মসূচি।
ইসলাম ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলো অনুশীলনের জন্য মানবসমাজে দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ সত্যকে ধারণ করে তাবলিগি জামাত যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী তাদের দাওয়াতের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। ইসলামি দাওয়াতের মূল প্রেরণা হচ্ছে কল্যাণকামিতা আর সারকথা হলো মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান। গুটিকতক লোক যাঁরা ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বাণী প্রচার করেন, তাঁদের এ দলবদ্ধ কার্যক্রমকে তাবলিগি জামাত বলে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে এই তাবলিগ করা হতো। পরবর্তীকালে বিশ্ব ইজতেমা নামক মহাসমাবেশটি তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে প্রতিবছর রাজধানীর অদূরে টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার রীতি বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে।
দাওয়াতে তাবলিগের আমলের ওপর সরাসরি পবিত্র কোরআনে ৬৩টি আয়াত নাজিল হয়েছে এবং অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ১০ হিজরিতে বিদায় হজের ভাষণের পর ৭০ থেকে ১৩৪৪ হিজরি পর্যন্ত তাবলিগের মেহনত বিচ্ছিন্নভাবে হয়। শুধু নিজে ভালো কাজ করলেই হবে না, অন্যকেও সৎকাজের কথা বলতে হবে। বিশেষ করে সমাজের সচেতন অংশ ধর্মীয় নেতা তথা মসজিদের ইমাম ও খতিবদেরও এই মহান দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হতে হবে। মানবকল্যাণ ও অগ্রগামিতার এ সাধনায় আত্মনিয়োগ করার আদেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে, আর তারাই সফলকাম’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)। শুধু নাম ও জাতীয়তার পরিচয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বাস ও কর্মে, চিন্তা ও চেতনায়, সংস্কৃতি ও জীবনধারায় পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার এটা অমোঘ নির্দেশ। এ নির্দেশ বহন করে দায়ীগণ আল্লাহর বান্দাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন এবং এ পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও কর্মের সংশোধনে এ দাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
মহানবী (সা.) তাবলিগ ও দাওয়াতের কাজেই গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। দাওয়াত ও তাবলিগের উদ্দেশ্যেই তিনি সুদূর তায়েফ গমন করেন এবং সেখানে তাঁকে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তাবলিগি দায়িত্ব পালনের বৃহত্তর তাগিদেই মহানবী (সা.) প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি মক্কাকে চিরবিদায় জানিয়ে মদিনায় হিজরত করেন এবং সেখানেই স্থায়ী আবাস গ্রহণ করেন। আরবের বিভিন্ন গোত্রের সর্দার ও গোত্রপ্রধান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান বরাবর ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ এই দাওয়াতি দায়িত্ব পালনের একেকটি কার্যক্রম মাত্র। আর এই কার্যক্রম নিরলসভাবে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়্যাতি জীবনের সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে চলেছিল। অতঃপর বিদায় হজের শেষ ভাষণে সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের যারা এখানে উপস্থিত আছো তারা (অনাগতকালের) অনুপস্থিত লোকদের কাছে আমার রেখে যাওয়া হেদায়েত, শিক্ষা ও নীতিমালা পৌঁছে দিয়ো।’ এই বলে অনাগতকালের উম্মতে মুহাম্মদির কাঁধে এই দাওয়াতি জিম্মাদারি তুলে দিয়ে গেলেন।
নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর সুমহান আদর্শ ও দায়দায়িত্ব সাহাবিদের ওপর অর্পিত হয়। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলে করিম (সা.) বলেছিলেন, ‘আমার একটি কথা হলেও তোমরা অন্যের কাছে পৌঁছাও।’
লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তর সমবেত মুসল্লিদের ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকারে এক পুণ্যভূমির রূপ ধারণ করে। তাই অনেকে আবেগ চেপে রাখতে না পেরে বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সঙ্গে তুলনা করে বসে। এটা কোনোমতেই শোভনীয় নয়। তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সঙ্গে তুলনা করা সম্পূর্ণ অন্যায়। কারণ হজ হলো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি অন্যতম ফরজ ইবাদত, যা না করলে গুনাহগার হতে হয়। কিন্তু তাবলিগের ইজতেমায় আসা ফরজ নয় এবং না এলে গুনাহগারও হতে হবে না। দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার একটির সঙ্গে অন্যটির কখনোই তুলনা করা চলে না। হজের মতো লোকসমাগম হলেই সেটাকে দ্বিতীয় হজ বলা কোনোমতেই সমীচীন নয়। তিনবার ইজতেমার মাঠে আসা তিন চিল্লা দিলে এক হজের সমান সওয়াবতুল্য—এসব ভিত্তিহীন কথা। বায়তুল্লাহ বা মক্কার কাবাগৃহের হজের সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমার কোনো তুলনা নেই।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.