কাবাগৃহ ও হজের পটভূমি -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুলমুনিম খান



মুসলমানদের প্রধান কিবলা পবিত্র কাবা শরিফ আল্লাহ তাআলার এক অপূর্ব সৃষ্টি। হজের মৌসুমে প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান কাবাঘর তাওয়াফ করতে মক্কায় যান। ভৌগোলিক দিক দিয়ে মক্কা মুকাররমা ও আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে অবস্থিত। মক্কা নগর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় আল্লাহ তাআলা ‘বাইতুল্লাহ’ বা ‘কাবাঘর’ মক্কাতেই স্থাপন করেন। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা সর্বপ্রথম দুনিয়াতে কাবাগৃহ নির্মাণ করে এখানে ইবাদত করেন। কাবাঘরটি আল্লাহর আরশে মুয়াল্লার ছায়াতলে সোজাসুজি সপ্তম আসমানে অবস্থিত সম্মানিত মসজিদে বাইতুল মামুরের আকৃতি অনুসারে ভিত্তি স্থাপন করা হয়। তাফসিরবিদের মতে, মানবজাতি সৃষ্টির বহু আগে আল্লাহ তাআলা কাবাগৃহ সৃষ্টি করেন, তখন জিন জাতি জমিনের একমাত্র বাসিন্দা ছিল। কারও মতে, আল্লাহ তাআলা বাইতুল্লাহর স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার বছর আগে সৃষ্টি করেন। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ হলো মসজিদুল হারাম। এরপরের মসজিদ হলো মসজিদুল আকসা। মসজিদুল হারাম নির্মাণের ৪০ বছর পর মসজিদুল আকসা নির্মিত হয়।’ (মুসলিম)
ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোকন হজ। মূলত ইসলামের পূর্ব থেকেই কাবাঘর জিয়ারত ও হজ আদায়ের প্রচলন ছিল। তাই হজের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। হজরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম বাইতুল্লাহ শরিফের হজ আদায় করেন এবং আল্লাহর আদেশে কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর বহুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তাঁর বিভিন্ন নবীর ওপর ওহী নাজিলের মাধ্যমে কাবার নির্দিষ্ট স্থান জানিয়ে দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী কাবাগৃহের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের কাজ চলেছে। এভাবে শত শত বছর অতিবাহিত হলেও আল্লাহর বান্দারা কাবাঘর জিয়ারত করত, সেখানে সমবেত হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজিরা দিত এবং আল্লাহর পবিত্রতা ও অংশীদারহীনতা ঘোষণা করত। এরপর আল্লাহর নবী হজরত শীস (আ.) কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ করলেন। দিন দিন একত্ববাদের সংখ্যা বাড়তে থাকল।
অতঃপর হজরত নূহ (আ.)-এর যুগের মহাপ্লাবনে কাবা শরিফ ধসে যায়। আল্লাহর হুকুমে হজরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে সঙ্গে নিয়ে কাবাগৃহের পুনর্নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে সৃষ্টিকর্তার দরবারে আকুল প্রার্থনা করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আজ্ঞাবহ কর, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এ কাজটি কবুল কর।’ আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর দোয়া কবুল করে নির্দেশ দিলেন, ‘হে ইবরাহীম! তুমি মানুষকে হজের জন্য আহ্বান কর।’ হজরত ইবরাহীম (আ.) বললেন, ‘হে আল্লাহ! সারা বিশ্বের মানুষ কি আমার ঘোষণা শুনবে?’ আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে ইবরাহীম! তুমি ঘোষণা কর আর তা মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’
আল্লাহর আদেশে হজরত ইবরাহীম (আ.) একটি উঁচু স্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বাঁয়ে, পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে কাবাঘরের হজ (জিয়ারত) করার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আসার জন্য লোকদের প্রতি আহ্বান করে হজের ঘোষণা করেন, ‘হে লোক সকল! বাইতুল্লাহ শরিফের হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে।’ সেদিন হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর ঘোষণা আকাশ ও জমিনের সবাই শুনেছে এবং ‘লাব্বাইক’ শব্দ বলে জবাব দিয়েছে। সেদিন যে যতবার ‘লাব্বাইক’ বলে জবাব দিয়েছে, সে ততবার হজ করার সৌভাগ্য লাভ করবে। আল্লাহর খলীলের সেই আহ্বান আজও যেন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। হজের মৌসুম এলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাবাগৃহের পানে ছুটে আসেন লাখো প্রেমিক। পরনে দুই খণ্ড সাদা কাপড়, মুখে তালবিয়ার মুহুর্মুহু ধ্বনি, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক’। বাস্তবে এটি ঐশীপ্রেমের এক অতুলনীয় নিদর্শন। লাব্বাইক ধ্বনি তুলে কাবাগৃহের চারপাশে প্রদক্ষিণ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় সাঈ বা ছোটাছুটি, মিনায় গিয়ে শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা—এসবই হজের কার্যক্রম।
হজরত ইবরাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধারা থেকে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। এরপর কয়েক শ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যথাক্রমে আমালেকা সম্প্রদায়, জোরহোম গোত্র, কুসাই বিন কিলাব, কুরাইশ, হজরত আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের (রা.), হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, সুলতান মুরাদ প্রমুখ পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারকাজ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশ কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বহস্তে কাবাগৃহে সর্বসম্মতিক্রমে যথাস্থানে কৃষ্ণপাথর স্থাপন করেন।
ইসলামের ইতিহাসে ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে নবম হিজরিতে হজের বিধান ফরজ হয়। পরের বছর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) হজ আদায় করেন। তিনি যেখানে, যে সময়ে, যে তারিখে, যে নিয়মে যেসব আহকাম-আরকান পালন করেন, প্রতিবছর ৮ থেকে ১৩ জিলহজ মক্কা মুকাররমা এবং এর ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্দিষ্ট নিয়মে সেভাবেই হজ পালিত হয়। হাজার হাজার বছর ধরে তাওহিদের ঘোষণাকারী হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের উচ্চারণ, নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ ও আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হচ্ছে। উম্মতে মুহাম্মদীর কণ্ঠে ১৪০০ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে কাবাগৃহের চারিপাশে সুমধুর ধ্বনি ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ উচ্চারিত হয়ে আসছে; যা হজরত ইবরাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর ঐতিহাসিক সুমহান ত্যাগের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.