তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ -চারদিক by মানস গোস্বামী

জয়দেবপুর রেলক্রসিং থেকে সোজা রাজবাড়ীর দিকের রাস্তাটার বিটুমিনের কালো আস্তরণের নিচে এই দুই দশক আগেও ছিল লাল সুড়কি বিছানো পথ আর দুই ধারে শতবর্ষী বিশাল বিশাল দেবদারু বৃক্ষের সারি। পথের শেষ মাথায় আমাদের রানী বিলাসমণি হাইস্কুল। আজ অবশ্য সভ্যতা আর উন্নয়নের ছোঁয়ায় সেই দেবদারুর একটিও অবশিষ্ট নেই। তবে শতবর্ষের স্মৃতি আর ঐতিহ্য বুকে নিয়ে চুন-সুড়কি আর কড়িকাঠের স্কুলটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এক বছর আগে ১৯ নভেম্বর খসে পড়ল সেই স্কুলের একটি স্তম্ভ; চলে গেলেন আমাদের জালাল স্যার। সবাই চেনেন জালাল বিটি নামে। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, ভীষণ ব্যক্তিসম্পন্ন চেহারা, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা—সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। মৃদু এবং স্বল্পভাষী। অঙ্কের শিক্ষক, নিচের ক্লাসে পড়ান না; শুধু নবম-দশম। তই ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত স্যারের ক্লাস পাইনি। স্কুলের বড়দের কাছে শুনেছিলাম, স্যার নাকি ভিষণ রাগী। ক্লাস নাইনে প্রথম জালাল স্যারের ক্লাস। স্পষ্ট মনে আছে, ঘণ্টা পড়তেই স্যারের অপেক্ষায় ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম সবাই। যথাসময়ে স্যার ক্লাসে এলেন এবং কোনো রকমের ভূমিকা ছাড়াই বললেন, ‘আজ পাটিগণিত করাব। এত দিন তোমরা যা শিখেছ সব ভুলে যাও। এখন থেকে নতুনভাবে শুরু হবে। ...প্রশ্নমালা খোলো, প্রশ্নটা দেখো।’ তারপর আরেক দিন স্যার এলেন অনেকগুলো কাঠের কম্পাস, স্কেল, ত্রিভুজ নিয়ে। বললেন, ‘আজ জ্যামিতি।’ এভাবেই শুরু হলো স্যারের হাত ধরে আমাদের গণিতের পথে যাত্রা। পরে ক্লাস নাইন থেকে টেন—এই দুই বছরে সরল, ঐকিক থেকে শুরু করে ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি, সম্পাদ্য, উপপাদ্য একে একে সব বাধা পেরোল। ক্লাসে স্যারকে কোনো দিন রাগ করতে হয়নি। এমন সমীহ আদায় করা ব্যক্তিত্ব ছিল যে স্যারের আদেশ অবশ্যই পালনীয় হতো। স্যার ছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মানুষ। পরে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। ওই স্কুলে একমাত্র আমাদের জালাল স্যারই ছিলেন বিএসসিবিটি—এই নিয়ে সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই আমার গর্বের অন্ত ছিল না। স্যারের কথায় গফরগাঁওয়ের একটা আঞ্চলিকতার টান ছিল, কিন্তু স্যার যখন ডেকে কথা বলতেন, তখন মনে হতো, কত আপন। স্কুলের ছাত্রাবাসের উঠোনের ঢাল পেরিয়ে একটু সামনেই স্যারের বাসা—বাসা বলতে একটি উঠোন ঘিরে মাটির মেঝের কয়েকটি টিনের ঘর। তারই একটি বৈঠকখানা। পাশেই একটা গোলাপ বাগান। ঘরটি চেয়ার টেবিল, টুল আর চৌকি দিয়ে ঠাসা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার প্রতিদিনই স্কুলের পরে ঘরটিতে লেগে থাকত উপচে পড়া ভিড়। কোনো সংখ্যার হিসাবে নয়, একটু বসা বা দাঁড়ানোর জায়গা পেলেই হতো। মাঝখানের চেয়ারে স্যার বসে একে একে সবাইকে তাদের সমস্যা বুঝিয়ে দিতেন। শুধু গণিত নয়, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদিরও চর্চা হতো। এই ঘরটিই পরে হয়ে উঠেছিল আমাদের তীর্থস্থান। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে জয়দেবপুরের তাবত্ প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আইনবিদ, চিকিত্সক, শিক্ষক ইত্যাদি পেশার মানুষ। এখানেই আমরা স্যারকে নিবিড়ভাবে পেতাম। শিক্ষাদানে স্যার ছিলেন যেমন অক্লান্ত তেমনি আন্তরিক। অঙ্ক শিখিয়ে স্যার যে কী আনন্দ পেতেন, তা স্যারের কাছে না পড়লে বোঝা যেত না। একটা অঙ্ককে তিনি বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন মেধার ছাত্রদের জন্য বোধগম্য করে তুলতেন, আর কোনোরকমে পাঠ্য বইয়ের একটা কঠিন অঙ্ক পেয়ে বসলেই হতো, স্যার ভেতর বাড়ির ট্রাংকে থাকা পুরোনো বাদামি পাতার একটা মোটা বই এনে খুলে দিতেন, ‘এটা করো দেখি।’ স্যারের এই আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়েছি বলেই স্কুলজীবনটা এত মধুময় কেটেছে। তখন যেকোনো সমস্যায় স্যারের শরণাপন্ন হতাম। স্যার যথাসাধ্য পরামর্শ দিয়ে বাহুপাশে রাখতেন। মনে আছে, পরবর্তীকালে ঢাকার একটি নামীদামি কলেজে পড়ার সময় জালাল স্যারের অভাববোধ করেছিলাম এবং একদিন আমি আনমনে স্যারের কথা মনে করে কলেজের কাঠবাদামের গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। বরাবরই আমি অঙ্কে কাঁচা ছিলাম কিন্তু কেন যেন স্যার আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন। স্পষ্ট মনে আছে, স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগে আগে একদিন স্যার আমাকে আড়ালে ঢেকে বললেন, ‘শুধুই স্কুলে এসে সময় নষ্ট করিস কেন, কাল থেকে স্কুলে না এসে আমার বাসায় চলে আসবি, সারা দিন পড়বি, যেটা বুঝবি না, সন্ধ্যায় আমার কাছে বুঝে যাবি।’ স্যারের এত ভালোবাসার যোগ্যই আমি ছিলাম না। আর এর প্রতিদানও কোনো দিন দেওয়া সম্ভব না।
স্যার প্রকৃত অর্থেই একজন বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষ ছিলেন। প্রতিটি বিষয় তিনি গ্রহণ করতেন যুক্তিগ্রাহ্য হলে। কয়েক বছর আগে স্যারের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখা করতে গেছি—কথা প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে গ্রেডিং সিস্টেম চালুর প্রসঙ্গটি আসে। তখন দেশজুড়ে এ পদ্ধতির ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। স্যারের গ্রেডিং পদ্ধতির প্রতি সমর্থন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কত পুরোনো দিনের মানুষ হয়েও আধুনিকতাকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে পারতেন। সে অর্থে স্যার ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই স্মার্ট। প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞানমনস্ক এই মানুষটিকে আমি ছেলেবেলা থেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। তিনি আমার জীবনের পথপ্রদর্শক। শুধু আমি নই, আমার বিশ্বাস, এই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক মানুষকে গড়ার কারিগর ছিলেন স্যার।
জীবদ্দশায় স্যারকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিইনি আমরা। এই তো গেল ২০০৫ সালে আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে স্যারকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এই নিয়ে অবশ্য স্যারের কোনো আক্ষেপ ছিল না। এই মানুষটি সারাটি জীবন শিক্ষাদানে আনন্দ পেয়েছেন—প্রাপ্তি তাঁর শত শত শিক্ষিত ছাত্র। অন্য কিছু আশা করেননি কখনো।
স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা হয় গত বছরের শবেবরাতের রাতে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী ক্ষীণদৃষ্টি কিন্তু স্মৃতিভ্রম হয়নি একটুও। অনেকক্ষণ থাকার পর বিদায়বেলা পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই স্যার আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমার চোখটা একটু দেখে যেয়ো।’ কিন্তু আমি চোখের ডাক্তার হয়েও স্যারের চোখ আর দেখে দিতে পারিনি। তার আগেই স্যার চলে গেলেন। এই কষ্ট শুধু আমারই; কাউকে বোঝানো যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.