জেন্ডার সংবেদনশীল শিক্ষা জরুরি

ঘরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের কাজের সমমূল্যায়ন করা ও যথাযথভাবে বেড়ে ওঠার বা বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি ও ক্ষেত্র তৈরিই হচ্ছে জেন্ডার ও ন্যায়সংগত উন্নয়নের মূল কথা। নারী ও পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিকভাবে আলাদা হলেও উভয়ের সামাজিক-রাজনৈতিক যোগ্যতা, সামর্থ্য ও অধিকার সমান। সংবিধানেও তার স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ সিডওর ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসকরণের লক্ষ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে প্রাথমিক স্তরে এবং নিম্নমাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। মাঝপথে ঝরে পড়া ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি, উচ্চস্তরে এই ব্যবধান অরও বেশি। পাশাপাশি দেখা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া ছাত্রীর সংখ্যা অনেক কম। কারিগরি, কৃষি ও প্রকৌশলবিদ্যায় ছাত্রী ভর্তির হার এখনো ১০ শতাংশ ছাড়ায়নি।
শিশুকাল থেকে ছেলেমেয়েদের শঙ্কামুক্ত আবহে যৌথভাবে বড় হওয়ার অবাধ পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন প্রচলিত ধ্যানধারণা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যথাযথ নীতি ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা। আমাদের দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা নারী-পুরুষের বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখছে। আমাদের প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, কবিতা, গল্প, ছবি—সবকিছুতেই রয়েছে লিঙ্গভেদ। পাঠ্যবিষয়ের জন্য এমন কোনো কবিতা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প নির্বাচন করা উচিত নয়, যা পুনরায় জেন্ডার অসংবেদনশীলতা এবং জেন্ডারবৈষম্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে (পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, একসাথে খেলি আর পাঠশালা যাই!)। পাঠ্যবিষয়ে যথাসম্ভব জেন্ডার অসংবেদনশীল ভাষা (সভাপতি, সমাজপতি, গৃহিণী) পরিহার করার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে জেন্ডারসমতা আনতে কিছু শব্দ যেমন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা—এগুলো ব্যবহার না করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক টার্মগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। শিক্ষানীতিকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হলে মেয়েদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন সংস্কৃতি ও প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের দেশে প্রাথমিক ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা পাওয়ার মতো তেমন কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ বা উন্নয়নমূলক কোনো প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের সুযোগ বৃদ্ধি করার বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
এ ছাড়া দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা, নারী ও পুরুষ শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা, নারীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের জন্য টয়লেটে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা, নারীশিক্ষকের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ এবং বদলির ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতের প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.