‘চাঁদের দেশে’ বাংলাদেশ উত্পল শুভ্র, গ্রেনেডা থেকে

নিল আর্মস্ট্রং আর সাকিব আল হাসান তাহলে মিলেই গেলেন!
কিসের সঙ্গে কী! এক নভোচারী আর এক ক্রিকেটার কীভাবে মেলেন এক বিন্দুতে! আহ্হা, এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন! একটু খেয়াল করে দেখুন না, ইতিহাস যে তাঁদের মিলিয়েই দিল।
চল্লিশ বছর আগে যে দিনে চাঁদে প্রথম পা রেখে আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের ছোট্ট একটা পদক্ষেপ আর মানবজাতির জন্য বিরাট এক লাফ’, চল্লিশ বছর পর সেই দিনেই সাকিবের একটা স্ট্রেট ড্রাইভ কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিরাট এক উল্লম্ফন নয়?
রোচের বলে সাকিবের ওই ছক্কায় নতুন একটা ইতিহাস লেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এই প্রথম পর পর দুটি টেস্ট জয়, এই প্রথম দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জয়—গ্রেনেডার ছায়া-ছায়া বিকেল আর সাত সমুদ্র তেরো নদী ওপারের সাকিবের দেশের ভোরে তো চাঁদেই পা রাখল বাংলাদেশের ক্রিকেট!
দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের দিনটা যে মানুষের চাঁদে পা রাখার চল্লিশতম বার্ষিকীর সঙ্গে মিলে গেছে, রফিকুল আলম তা জানতেন না। বাংলাদেশের ক্রিকেটের নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান তার পরও কাকতালীয়ভাবে চাঁদকেই টেনে আনলেন! ‘এত দূর যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসার পর মনে হলো যেন চাঁদে এলাম। আর বাংলাদেশের এই জয়কে মনে হচ্ছে চাঁদে পা রাখার মতো।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে অত ভাবালুতা নেই। চাঁদ-টাঁদের মতো অনেক দূরের বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তাঁদের মধ্যে গুঞ্জরিত একটাই শব্দ। হোয়াইটওয়াশ! হোয়াইটওয়াশ! সারা জীবন বাংলাদেশ যা হয়ে এসেছে, এই প্রথম তা অন্যকে করল।
কলিন ক্রফটের টেস্ট ক্যারিয়ারে পরাজয়ের সঙ্গে তেমন দেখাই হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্দশা দেখেন আর কষ্ট পান অধুনা ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক। বিবিসির হয়ে সিরিজ কভার করছেন। হাতে রেকর্ডার, কানে হেডফোন—কলিন ক্রফট হো হো করে হাসছেন! ‘ওহ্ গড! বাংলাদেশের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোয়াইটওয়াশ! আমি আজ সারা দিন হাসব।’
তোর ইচ্ছা হয়েছে, হাসতে থাক, কে মানা করেছে? বাংলাদেশও আজ হাসছে। আনন্দে হাসছে। গর্বে হাসছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের কাছে পরাজয়ের লজ্জা ভুলে গিয়ে হাসছে।
সবচেয়ে বেশি হাসছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। হাসতে হাসতেই আবার কালো হয়ে যাচ্ছে তাঁদের মুখ। মনে পড়ে যাচ্ছে, কদিন আগে কী অপদস্থই না হতে হয়েছে তাঁদের! টি-টোয়েন্টি বিপর্যয়ের পর এমন সব কথা শুনতে হয়েছে যে, এমন অবিস্মরণীয় সাফল্যের আনন্দও তা ভুলিয়ে দিতে অসমর্থ। ‘খু-উ-ব খুশি’ দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেই তাই অনিবার্যভাবে পরের কথাটা হচ্ছে, ‘সবচেয়ে বেশি খুশি, কারণ...’।
গ্রেনেডায় পরশু সকাল থেকেই বৃষ্টি। এমনই অঝোর ধারায় যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের মাহেন্দ্রক্ষণটি আর খেলোয়াড়দের হাতে থাকছে বলে মনে হলো না। বৃষ্টিতে সেটি ভেসে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রবল হয়ে উঠল একসময়। ক্যারিবিয়ানের ধর্ম অনুযায়ী সেই বৃষ্টি থামতেই ঝকঝকে রোদ।
কিন্তু একসময় যে সেই রোদেও মেঘলা দেখাচ্ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশ। ৬৭ রানে ৪ উইকেট নেই! ২১৫ করলেই ইতিহাস—কিন্তু এত সব অর্জনের হাতছানির চাপ আছে, সঙ্গে আছে চতুর্থ ইনিংসে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আলোয় সাজিয়ে রাখা উত্সবের মঞ্চে হঠাত্ই আঁধার নেমে আসবে না তো!
দুই হাসান তা হতে দিলেন না। রকিবুল হাসান নেমেই এমন ব্যাটিং করতে শুরু করলেন যে, মনে হলো এই ছোট্ট টার্গেটটা ছুঁতে এত ঝামেলা তাঁর একদমই পছন্দ হচ্ছে না! আর সাকিব আল হাসান তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন।
বাংলাদেশের চতুর্থ উইকেটটি পড়ে যাওয়ার পর মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের উত্সব দেখতে দেখতে নেমেছেন। রকিবুলের সঙ্গে তাঁর ১০৬ রানের জুটির প্রতিটি রান জল ঢেলে দিয়েছে সেই উত্সবে। শেষে ওই ছক্কা!
শুধুই একটা ছক্কা! বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন এক ইতিহাস যে লেখা হলো ওই ছক্কায়! সাকিব আল হাসানকে এখন থেকে নিল আর্মস্ট্রং নামেই ডাকুন না!

No comments

Powered by Blogger.