একটি পার্টনারশিপের গল্প by উত্পল শুভ্র

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের এর চেয়ে বড় পার্টনারশিপও আছে। কিন্তু পরিস্থিতি-তাত্পর্য-প্রভাব বিবেচনায় গ্রেনেডার দ্বিতীয় ইনিংসে রকিবুল হাসান ও সাকিব আল হাসানের ১০৬ রানের পার্টনারশিপটির কাছে সেসবও পিছিয়ে। পরশু রাতে গ্রেনেডা গ্র্যান্ড বিচ রিসোর্টের সুইমিং পুলের পাশে বসে টেস্ট ও সিরিজ জেতানো পার্টনারশিপের দুই অংশীদার ফিরে তাকালেন হিরণ্ময় সেই স্মৃতির দিকে—

পর পর দুই ওভারে দুই ওপেনারের বিদায়ে বাংলাদেশ যখন ২৯/২, তখন নামলেন রকিবুল হাসান। এই টেস্ট ম্যাচের ভাগ্য তখন দোদুল্যমান। রকিবুল নেমেই অমন পাল্টা আক্রমণ করে চমকে দিলেন সবাইকে।
রকিবুল: মানসিকভাবে পজিটিভ ছিলাম। ঠিক করেছিলাম, পরিস্থিতি যা-ই থাক, পজিটিভ ক্রিকেট খেলব। কোচ বলেছিলেন, ‘অবস্থা যা-ই হোক, পজিটিভ খেলবে। মারার বল মারবে।’ আমি তা-ই করেছি। আউট হয়ে যাব বা হেরে যাব—এসব চিন্তা মাথায় ঢুকতেই দিইনি। সাকিব আসার পর কাজটা একটু সহজ হয়ে গেল।
সাকিব: ওই পরিস্থিতিতে অমন পজিটিভ খেলা সহজ নয়। রকিবুল খুব ভালো ব্যাটিং করেছে। প্রথম ইনিংসের পর কোচ ওকে বলেছে, টেস্ট ক্রিকেটে ওকে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং করতে দেখেছেন আজ। এটা ওকে অনেক কনফিডেন্স দিয়েছে।
সাকিব নামার সময় স্কোর ৪ উইকেটে ৬৭। আর একটা উইকেট পড়লেই বাংলাদেশের স্বপ্ন ধূসর হয়ে যায়। উইকেটে গিয়ে সাকিব কী বললেন রকিবুলকে, রকিবুলই বা সাকিবকে কী?
রকিবুল: সাকিবের সঙ্গে আমি অনেক আগে থেকেই ব্যাটিং করি। ওর সঙ্গে বেশ কয়টা ভালো পার্টনারশিপ আছে। ওর সঙ্গে ব্যাটিং করতে খুব ভালো লাগে। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট খুব ভালো হয়। আর ও পজিটিভ খেলে বলে কাজটা সহজ হয়।
সাকিব: আমি ব্যাটিংয়ের সময় বেশি কথা বলি না। নামার পর ও-ই আমাকে যা বলার বলেছে। বলেছে, বোলিং এমন কিছু হচ্ছে না, সোজা-সোজা খেললেই চলবে।
ড্যারেন স্যামি আর টিনো বেস্ট বোলিং করছেন তখন। তিন উইকেট নিয়ে স্যামি তখন উজ্জীবিত। বোলারদের নিয়ে কী পরিকল্পনা ঠিক করেছিলেন তাঁরা দুজন?
সাকিব: আমরা এমন কোনো প্ল্যান করি নাই যে, ও এভাবে বল করছে তুই এভাবে খেল। যে যার মতো খেলি, যার যেভাবে ভালো মনে হয়। এটা কখনো প্ল্যানিং করি না যে, নির্দিষ্ট কোনোভাবে খেলতে হবে।
রকিবুল: পর পর কয়টা উইকেট পড়ে যাওয়াতে ওরা তখন খুব অ্যাগ্রেসিভ বোলিং করছিল। তবে উইকেটটা ভালো ছিল। এ কারণে ওদের খেলতে পারব না এমন মনে হয়নি।
প্রথম ইনিংসে খেমার রোচের গতির তোড়ে উড়ে গেছে বাংলাদেশ। রকিবুল-সাকিব দুজনকেই আউট করেছেন। রকিবুলের হাতে বাউন্সার মেরে টালমাটাল করে দিয়েছেন তাঁকে। সেই রোচ বোলিংয়ে আসার পর সেটি হয়ে গেল ম্যাচের নির্ধারক মুহূর্ত
সাকিব: আমার মনে হয়েছে, ওকে যদি একটু সাবধানে খেলি তাহলেই হবে। কারণ ও বেশিক্ষণ বোলিং করতে পারবে না। সেই তিন দিনের ম্যাচ থেকে অনেক বল করায় ও অনেক ক্লান্ত। বেশি জোরেও করতে পারবে না। আর উইকেট না পেলে তো আরও না। মনে হয়েছে, ওকে যদি পার করে দিতে পারি, তাহলে বাকি বোলারদেরও আরামসে খেলতে পারব।
রকিবুল: প্রথম ইনিংসে যেটা হয়েছে, ক্রিকেটে এমন হয়ই। বোলার আর ব্যাটসম্যানের মধ্যে একটা লড়াই হয়, বোলার গায়ে-টায়ে মারে, ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যায়। তবে আমি সেটা মনে রেখে ব্যাটিং করি নাই। আমি আমার মতো খেলে গেছি।
৪৮ রানে গিয়ে সাকিব রোচের পর পর তিন বলে তিনটা চার মারলেন। ম্যাচটা কাদের হাতে, সেটাও যেন পরিষ্কার হয়ে গেল এতে। পরিকল্পনা করেই কি রোচের ওপর চড়াও হয়েছিলেন সাকিব?
সাকিব: না না, অমন কোনো প্ল্যান ছিল না। চার মারার বল ছিল, মেরেছি। একটা ছিল স্কয়ার কাটের বল, স্কয়ার কাট মেরেছি। একটা ছিল ড্রাইভের বল, ড্রাইভ মেরেছি। একটা পুলের বল ছিল, পুল মেরেছি। ওই সময় ও কী করবে, আমি অনুমান করতে পারছিলাম। স্কয়ার কাটটা করার পর বুঝেছি, ও ওপরে করবে। ওপরে করেছে, চার মেরেছি। পরের বলটা আমি জানতাম একটু শর্ট লেংথ করবে। করেছে, চার মেরেছি।
রকিবুল: ওর ওই তিনটা চার দেখে খুব মজা পেয়েছি।
রকিবুল-সাকিবের পার্টনারশিপে ৫০ হলো, একসময় এক শও। লড়াইয়ে নিমগ্ন ওরা দুজন কি মাইলফলকগুলো খেয়াল করেছিলেন?
সাকিব: ফিফটি পার্টনারশিপটা খেয়াল করি নাই, হান্ড্রেড পার্টনারশিপটা করেছি। আমাদের পার্টনারশিপে যখন ৮৯ হলো, তখন ওকে বলেছি আর ১১ লাগে রে!
রকিবুল: পার্টনারশিপটা ৫০-৬০-৭০ হয়ে যাওয়ার পর আমরা আলাপ করছিলাম, কাজটা অর্ধেক হয়েছে। আর ৩০-৪০টা রান যদি যোগ করতে পারি, তা হলে কাজটা আরও সহজ হয়ে যাবে।
একসময় স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল—হান্ড্রেড পার্টনারশিপ। কোন শটে তা হলো মনে আছে ওদের?
সাকিব: রোচকে যে তিনটা চার মারলাম, তখনই তো হলো। তবে আমি সেটা খেয়াল করি নাই। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, হয়েছে? ও বলল, হ্যাঁ, হয়েছে। আমি বললাম, তুমি দেখেছ? ও বলল, হ্যাঁ, আমি স্কোরবোর্ডে দেখেছি।
ভালো একটা পার্টনারশিপে দুই ব্যাটসম্যানের একে অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপার থাকে। কোনো বোলার হয়তো নির্দিষ্ট কিছু করার চেষ্টা করছে, সেটি খেয়াল করে পার্টনারকে বলা। অথবা ফিল্ডিংয়ে কোনো পরিবর্তন।
সাকিব: না, সে রকম কিছু বলেছি বলে মনে পড়ে না। আমরা নরমাল কথাবার্তাই বলেছি।
রকিবুল: ড্যারেন স্যামি যখন বল করছিল, ও মিড উইকেটটা পুরো ফাঁকা রেখেছিল। ওর প্ল্যানটা ছিল, সাকিব যেন অ্যাক্রস দ্য লাইন খেলে। ওই ফিল্ডিংটা খেয়াল করে আমি সাকিবকে বলেছি, ও কিন্তু এই প্ল্যান করেছে। তুই তোর প্ল্যান অনুযায়ী খেল, ওর ফাঁদে পা দিবি না।
রকিবুল যখন স্যামির বলে কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে ফিরলেন, জয়ের জন্য তখনো চাই ৪২ রান। ম্যাচটার কি আবার একটা নাটকীয়তায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা তখন!
সাকিব: ও আউট হওয়ার আগেই আমি ওকে বলছিলাম, আরও ১৫-২০টা রান হলে তার পর যা-ই হোক হবে, কোনো সমস্যা হবে না। আউট হওয়ার পর তো খারাপ লেগেছে। তবে তার পরও কনফিডেন্ট ছিলাম, মুশফিক ভাই আসছে। মুশফিক ভাই সব ইনিংসেই ৩০-৪০ করে করেছে। মুশফিক ভাই আউট হয়ে যাওয়ার পর একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যদিও তখন ২০ রান দরকার ছিল (আসলে ১৪), তার পরও অনেক রান!
রকিবুল: আমি শেষ পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিলাম। একটু আগে খেলে ফেলায় ক্যাচ উঠে গেছে।
১০৬ রানের এই পার্টনারশিপটিই টেস্ট ও সিরিজ জেতাল বাংলাদেশকে। সাকিব ও রকিবুলের কাছে এটি তাই স্মরণীয় হয়ে থাকারই কথা।
সাকিব: উইনিং পার্টনারশিপ। আসল কথা হলো, খুব প্রয়োজনের সময় হয়েছে পার্টনারশিপটা। রকি আর অ্যাশ যখন ব্যাটিং করছিল, আমি আর মুশফিক ভাই আলাপ করছিলাম, এখনই একটা পার্টনারশিপ খুব জরুরি। আমি বললাম, এটা না হলে পরেরটাতে বড় একটা পার্টনারশিপ হতেই হবে। নইলে আমরা পারব না।
রকিবুল: সাকিবের এটা প্রথম ক্যাপ্টেন্সি। অধিনায়ক হিসেবে ওর প্রথম ম্যাচেই ওর সঙ্গে এমন একটা পার্টনারশিপ করতে পারলাম। এটা ওর কাছে যেমন স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তেমনি আমার কাছেও।

No comments

Powered by Blogger.