শেখ হাসিনার রাজনীতি কেন এতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিল by সালেহ উদ্দিন আহমদ

বর্তমান পরিবেশে শেখ হাসিনা সম্বন্ধে খুব মৃদুভাবে সত্য উচ্চারণ করতে হলে বলা যায়, তিনি একজন পরাজিত ও বিতাড়িত রাজনীতিবিদ। কিন্তু মৃদু উচ্চারণে এখন কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করেন না। তাঁকে নিয়ে যেসব বিশেষণ এখন শোনা যায় তা হলো—প্রতিশোধপরায়ণ, স্বৈরাচারী, আক্রমণাত্মক, হিংসাপরায়ণ এবং মারাত্মক একগুঁয়ে।

বাংলাদেশে তাঁর নামে ভালো বিশেষণ যোগ করার লোকেরও অভাব নেই। তবে তাঁরা বর্তমান পরিবেশে চুপ থাকছেন। রাজনীতিবিদ পিতার ঘরে জন্ম নিলেও বাবার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাসিনার পরিচয় ছিল একজন গৃহবধূ ও পরমাণুবিজ্ঞানীর স্ত্রী। আমরা শেখ হাসিনার রাজনীতি জীবনের কিছু প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে বুঝতে চেষ্টা করব, কেন তিনি দিনে দিনে আরও বেপরোয়া ও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলেন।

মুজিব পরিবার হত্যা

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপরিবারে পরিবারের হত্যাকান্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনা তাঁর বাবা-মা ও তিন ভাইকে হারান। তিনি ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা তখন ছিলেন বিদেশে। স্বাভাবিকভাবে এই একটা ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে তাঁর জীবনকে সুনির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলে। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু ঘটনা যোগ হয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

শেখ হাসিনা যখন রাজনীতিতে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৪ বছর। তখনই তিনি তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছিলেন। তিনি অনেককেই তখন তাঁর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছার কথা বলেছেনও। হাসিনা বলেছেন, রাজনীতিতে আসার তাঁর প্রাথমিক প্রেরণা ছিল তাঁর ‘বাবার হত্যার বিচার চাওয়া এবং বিচার করা’।

সাধারণত যাঁরা পারিবারিক ট্র্যাজেডি নিয়ে আচ্ছন্ন থাকেন, তাঁরা পরিবারের বাইরে অন্য কাউকে সহজে বিশ্বাস করেন না। এই অবিশ্বাসের মূল কারণ হলো, অন্যরা তো তাঁর মতো ভিকটিম বা ভুক্তভোগী নন। তাই যাঁরা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এনেছিলেন, সেই ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতারা দ্রুতই শেখ হাসিনার আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

প্রকৃতপক্ষে পুরোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতাই কখনো শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন না, যদিও অনেকেই দলে স্থান পেয়েছিলেন। হাসিনার দারুণ ক্ষোভ ছিল, তাঁর পিতার হত্যার পর কেন এই নেতারা রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ করেননি। অন্যদিকে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। হাসিনাকে তাঁদের নাম কখনো উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। যেকোনো আনন্দ ও বিপদের সময় তিনি তাঁর ছোট বোন রেহানাকে তাঁর কাছে রাখতেন।

এক ঘরে দুই পির

শুধু শেখ মুজিবই নন, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আরেকজন জনপ্রিয় নেতা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শরিক হলেন আরেক শোকাতুর পরিবারের প্রতিনিধি। তিনি বেগম খালেদা জিয়া। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে যাঁরা হত্যা করেছিলেন বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁরা বিভিন্নভাবে চরম শাস্তি পেয়েছিলেন।

বেগম জিয়ার মধ্যে তাই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মধ্যে প্রতিশোধের কোনো উপকরণ ছিল না। তাঁর মূল বাধ্যবাধকতা ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষা করা। জিয়ার মৃত্যুর পর এম এ মতিন, জামাল উদ্দিন আহমেদ ও শাহ আজিজুর রহমানের উপদলীয় কোন্দলে বিএনপি একটি অকেজো রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল।

এই দুই পরিবারের প্রতিনিধি দুই ব্যক্তিগত কারণে রাজনীতিতে নামলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময়ে। তাঁরা একটা সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে সখ্য গড়ে তুললেন। সেই লক্ষ্য হলো—এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা, যদিও দুজনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এরশাদের রাজত্ব শেষে পরের দশক ছিল এই দুই নেত্রীর নিজেদের ক্ষমতা দৃঢ়করণের সময় এবং কে কাকে কোণঠাসা করে ক্ষমতা থেকে সরাতে বা দূরে রাখতে পারবেন, সেই প্রতিযোগিতার।

কয়েকবার দুই নেত্রীর মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হলো। একদল ক্ষমতায় গেলে অন্য দল সংসদ বয়কট করতেন। মূলত সহাবস্থানের পরিবর্তে এই দুই দলের একে অন্যকে অস্বীকার করার রাজনীতি দেশে এক অস্বাস্থ্যকর রাজনীতির উত্থান ঘটাল।

স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, দুই দলের শীর্ষে ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুই অগ্রগামী সৈনিক। তাঁদের মৃত্যুর পর এই দুই দলেরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা না করে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ ছিল। তার পরিবর্তে দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক নতুন বিতর্ক—কে প্রথম ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা?

শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা ও জিয়াউর রহমানের কালুরঘাট বেতারের ভাষণকে কেন্দ্র করে দুই দলই দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল। শেখ হাসিনা বিএনপির এই উদ্যোগে খুঁজে পেলেন স্বাধীনতাসংগ্রামে শেখ মুজিবের অবদানকে অবনমন করার নতুন ষড়যন্ত্র। বিএনপির বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ আরও ধারালো হয়ে ওঠে। কখনো কখনো বেগম জিয়ার ওপর হাসিনার ব্যক্তিগত আক্রমণ অশালীনতার পর্যায়ে উঠেছিল।

আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে জিয়াউর রহমানকে একজন ভালো সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছিল। কিন্তু যখন বিএনপি তাঁকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করে শেখ মুজিবের বিপরীতে দাঁড় করল, হাসিনার দল তখন জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে নানা প্রশ্ন শুরু করল। বলা হলো, জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের চর এবং তিনি যুদ্ধের সময় নিষ্ক্রিয় ছিলেন।

হাসিনা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ নিয়ে বিএনপির দাবিতে দারুণ ক্রুদ্ধ ছিলেন। অনেক পর্যবেক্ষক বলবেন, হাসিনার মানসিক জগতে এই একটি উপকরণ নানাভাবে অনেক বিষক্রিয়া ছড়িয়েছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভায় শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হলো। নিহত হলেন আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক আইভি রহমানসহ অনেকে। বেগম জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী। হাসিনা সরাসরি বিএনপিকে দায়ী করলেন এই হামলার জন্য। বিএনপি শাসনামলের গ্রেনেড হামলার ঘটনা নতুন জ্বালানি ঢালল শেখ হাসিনার পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধের আগুনে।

ওয়ান ইলেভেন সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মানুষ দেখল এক নতুন হাসিনাকে। ধীরে ধীরে সেই হাসিনা আরও বেপরোয়া, আরও আত্মবিশ্বাসী এবং কুক্ষিগত ক্ষমতার ধারক হয়ে ওঠেন। এই ১৫ বছরের শাসনকালে বলা যায় তিনি ক্রমান্বয়ে তাঁর বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার সব চেষ্টা চালিয়েছেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাষ্ট মামলায় চেক অনিয়মের অভিযোগে হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, বেগম জিয়া গ্রেনেড হামলায় তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে অনুকম্পা দেখিয়ে জেলে রাখার বদলে গৃহবন্দী রাখার ব্যবস্থা করেছেন।

বিরোধীদের যেকোনো উপায়ে কোণঠাসা করে রাখাকে হাসিনা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে দেখতেন। তিনি তাঁর আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তাঁর ওপর গ্রেনেড হামলাকে সচেতনভাবেই যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করতেন। শেখ হাসিনা মনে করতেন, তাঁর পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার জন্য প্রতিপক্ষরা সব সময় সচেষ্ট। তাই তিনি ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন’ পাস করিয়েছিলেন ২০০৯ সালে।

যেকোনো উপায়ে হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যাঁদের তিনি তাঁর শত্রু মনে করতেন কিংবা যাঁদের তিনি দেশের জন্য ‘ক্ষতিকর’ মনে করতেন, তাঁদের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন বা সীমিত করাকে তিনি তাঁর অধিকার মনে করতেন। শেখ হাসিনার বিগত দিনের বক্তৃতা-বিবৃতি খুঁজে দেখলে একটা জিনিস পরিষ্কার হবে। সেটি হলো, তিনি ভাবতেন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি দারুণ অবিচার করা হয়েছে এবং সেগুলোর প্রতিবিধান করা তাঁর দায়িত্ব ও অধিকার।

অনেকেই মনে করেন, পারিবারিক ট্র্যাজেডিগুলোর জন্য তিনি দারুণভাবে মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। হাসিনা নিজের নামের চেয়েও তাঁর বাবার নামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাকে অগ্রাধিকার দিতেন। হাসিনা মনে করতেন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তিনি বঙ্গবন্ধুর ‘লিগ্যাসি’ ও অর্জন দেশে সম্পূর্ণভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যেতে পারবেন। তিনি দেশের প্রতিটি বড় সরকারি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর নাম জুড়ে দিতেন এবং যত্রতত্র বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু বসিয়ে জনগণকে তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন।

হাসিনার ‘অতি চেষ্টা’ সফল হয়নি বরং হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন আমরা এই দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঠিকানা মুছে ফেলার জন্য কিছু লোককে বুলডোজার নিয়ে ৩২ নম্বর রোডে ঘোরাফেরা করতে দেখছি।

আর শেখ হাসিনা? হয়তো ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়েই তাঁকে বাকি জীবন দেশের বাইরে কাটাতে হবে।

* সালেহ উদ্দিন আহমদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- ই-মেইল: salehpublic711@gmail.com
- মতামত লেখকের নিজস্ব

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-11-25%2F2hhb5xef%2Fsheikhhasina-cartoon.jpg?rect=18%2C0%2C737%2C491&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif

No comments

Powered by Blogger.