আন্তর্জাতিক সংকট যেভাবে স্বৈরশাসকদের শক্তিশালী করে by সেনেম আয়দিন-দ্যুজগিট
স্বৈরশাসকেরা ভোট জালিয়াতি, ডিজিটাল নজরদারি, আইন ও প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মতো করে বদলে নেওয়াসহ নানা কায়দাকানুন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে আরও শাণিয়ে নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু বড় গণতান্ত্রিক দেশের নৈতিক ব্যর্থতা গণতন্ত্রকে একটি আকর্ষণীয় মডেল হিসেবে দুর্বল করে দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ঘটে চলা এ বড় পরিবর্তনগুলো কীভাবে স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে আরও শক্তিধর করে তুলছে, তা প্রায়ই নজরের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আজকের বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে যে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সংঘাতগুলো বেড়ে চলেছে, তা নির্বাচনী প্রতিযোগিতাময় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এর বড় উদাহরণ রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ঘরোয়া গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
হাঙ্গেরির জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল, অর্থাৎ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের এক মাসের কিছু বেশি সময় আগে। ওই সময় ভোট চাইতে গিয়ে ওরবান বারবার বলেছিলেন, কেবল তিনিই হাঙ্গেরিকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ দলকে যুদ্ধবাজ বলে প্রচার করেছিলেন। কারণ, প্রতিপক্ষ ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা দিতে চেয়েছিল। আর ওরবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হাঙ্গেরিকে তিনি যুদ্ধ থেকে দূরে রাখবেন।
সরকারি প্রচারে ভরপুর মিডিয়ার প্রভাবে অনেক হাঙ্গেরিয়ান ওরবানকে ‘শান্তির রক্ষক’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। এমনকি বিরোধী দলের কিছু সমর্থকও ভয় পেয়েছিলেন, সরকার বদলালে হাঙ্গেরি হয়তো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
ওরবান ব্রাসেলসেও যুদ্ধকে ব্যবহার করেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি হুমকি দেন, ইউরোপীয় কমিশন যদি হাঙ্গেরির জন্য আটকে রাখা অর্থ ছাড় না দেয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে সাহায্য করার যে পরিকল্পনা করেছে, তা তিনি আটকে দেবেন।
দেশে ফিরে ওরবান জনগণকে এটাকে দেখান, ‘ইউরোপের অভিজাতরা হাঙ্গেরির টাকায় ইউক্রেনকে সাহায্য করতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি সেটা ঠেকিয়ে দিয়েছি।’ অর্থাৎ তিনি এটিকে তাঁর বিজয় হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন।
সরকারপন্থী মিডিয়া রাশিয়ার মতো একই বয়ান প্রচার করতে থাকে। তারা বলে, হাঙ্গেরির অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য রাশিয়ার আগ্রাসন দায়ী নয়; বরং এর জন্য দায়ী রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা। এ মিডিয়া আরও দেখায়, পুতিনের সঙ্গে ওরবানের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকার কারণে হাঙ্গেরি সস্তায় জ্বালানি পেতে পারে, কিন্তু বিরোধীরা জিতলে সেই জ্বালানি সরবরাহ আটকে যাবে। শেষ পর্যন্ত ওরবানের নেতৃত্বাধীন জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন জেতে, সংসদে তাদের সুপারমেজরিটি বজায় থাকে এবং ওরবানের ক্ষমতা আরও পোক্ত হয়।
তুরস্কেও একই রকম ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে এরদোয়ান ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কূটনীতিকে জোর দিয়ে প্রচার করেন। তিনি বিশেষ করে কৃষ্ণসাগরের শস্য রপ্তানি চুক্তি দেখিয়ে জোর প্রচারণা চালান।
এরদোয়ান নিজেকে একমাত্র নেতা হিসেবে দেখান, যিনি তুরস্ককে যুদ্ধের বাইরে রেখে একই সময়ে তার বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে পারেন।
সরকারপন্থী গণমাধ্যম সতর্ক করে বলতে থাকে, বিরোধীরা জিতলে তুরস্ক পুরোপুরি পশ্চিমাদের যুদ্ধচেষ্টার সঙ্গে একাত্ম হবে। ওই নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সিদ্ধান্তে আসতে দ্বিতীয় দফা ভোটের দরকার হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এরদোয়ানই জয়ী হন।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার ইউক্রেন আক্রমণের পর হাঙ্গেরি ও তুরস্কে যে রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায়, তা হলো আন্তর্জাতিক সংকট সব সময় স্বৈরশাসনের দুর্বলতা প্রকাশ করে না; বরং তা তাঁদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে পারে।
* সেনেম আয়দিন-দ্যুজগিট, সাবাঞ্জি ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং ইস্তাম্বুল পলিসি সেন্টারের পরিচালক
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
![]() |
| যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রয়টার্স |

No comments