ভোটের আগে যে ‘বিজয়’ দরকার বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির by এ কে এম জাকারিয়া
অন্তর্বর্তী সরকার তারপরও দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিল সম্ভবত কৌশলগত কারণে। সরকার এখন অন্তত বলতে পারবে যে তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার সুযোগ দিয়েছিল। আর রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেরা এই ‘সুযোগ’ নেয়নি সম্ভবত কৌশলগত বিবেচনা থেকেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের আগেই একটি ‘বিজয়’ পেতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো। এর ওপর ভর করে তারা নির্বাচনের মাঠে নামে। এই পুঁজি ছাড়া দলগুলো ভরসা পায় না।
নব্বইয়ের পরের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চায় না, ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা নানা ফন্দিফিকির করে। নির্বাচনে কারচুপির কৌশল নেয়। আন্দোলন করে বিরোধী পক্ষকে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করে নিতে হয়। আর সেই বিজয় নিয়ে মাঠে নামে বিরোধী পক্ষগুলো। ইতিহাস বলে, নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষেই গেছে।
২০১৪ থেকে ২০২৪—এই ১০ বছরের ইতিহাস অবশ্য ভিন্ন। কর্তৃত্ববাদ থেকে ফ্যাসিবাদী শাসনের এই সময়ে নির্বাচন বলে কিছুই আর কার্যকর ছিল না। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য এ দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অনেক রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। পরাজিত পক্ষ পালিয়েছে এবং তাদের দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান দেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করছে এবং সে অনুযায়ী দেশ ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তির বিপরীতে বিজয়ী পক্ষ অনেকগুলো। এই বিজয়ী পক্ষগুলোই লড়বে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার হটানোর যে ‘বিজয়’, সব প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলই এর অংশীদার। তাই নির্বাচনের আগে দলগুলোর নতুন বিজয় দরকার। রাজনীতিতে এখন যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও পাল্টাপাল্টি, তার পেছনে আসলে কাজ করছে নির্বাচনের আগের বিজয় অর্জনের লড়াই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরের ধারাবাহিকতায় তিনটি দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেভাবেই বিবেচনা করে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে এই রাজনৈতিক দল তিনটি এখন নির্বাচনপূর্ব ‘বিজয়’ এর হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত।
বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট। জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কার ইস্যুতে দলটি যেসব ভিন্নমত দিয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও তারা অটল থাকতে চায়। জামায়াত চায় জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট। তারা সংসদের দুই কক্ষেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক বা পিআর পদ্ধতির দাবি তুলেছে। তবে নিম্নকক্ষে না হলেও উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে তারা কোনোভাবেই পিআরের দাবি ছাড়তে রাজি নয়।
অন্যদিকে গণভোটের তারিখ নিয়ে এনসিপির অবস্থান তেমন কঠোর নয়। তারা জাতীয় নির্বাচনের দিন বা আগে যেকোনো সময়েই গণভোট অনুষ্ঠানে সম্মত আছে। তারাও উচ্চকক্ষে পিআর এবং নোট অব ডিসেন্ট ছাড়াই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়। এনসিপি অবশ্য এখনো জুলাই সনদে সই করেনি। তবে দলটির জোরালো দাবি হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে।
জামায়াতসহ আট দল এসব দাবিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। আজ এই দলগুলোর ঢাকায় একটি সমাবেশ হওয়ার কথা আছে। বিএনপি নির্বাচনী সমাবেশ ও প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয় থাকলেও সম্ভবত তাদের দাবির পক্ষে কর্মসূচি না করার কৌশল নিয়েছে। এনসিপিও এই ইস্যুতে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে না। তবে নেতাদের মুখে গরম-গরম কথা থেমে নেই।
সবকিছু মিলিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তিনটি দলের এই বিরোধপূর্ণ ও পাল্টাপাল্টি অবস্থান রাজনীতিতে উত্তেজনা তৈরি করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও অনেকের মধ্যে শঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে একমত হওয়ার জন্য যে সাত দিন সময় দিয়েছিল, তা গতকাল শেষ হয়ছে। ঘোষণা অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা একমত হতে না পারায় অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই এখন এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরকার তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এই তিন দলের কোনোটির দাবি একেবারে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবে?
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দিয়েছিল ঠিকই, তবে সরকার একেবারে হাত গুটিয়ে বসে ছিল, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা জানি যে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি নিয়ে দর-কষাকষি ও আলোচনা চালিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব বা কোন দল কোন ক্ষেত্রে কতটুকু ছাড় দিতে চায় বা পারে, তা বিবেচনায় নিয়েই সম্ভবত সরকার তাদের সিদ্ধান্ত নেবে।
আগেই বলেছি, নির্বাচনের আগে এই দলগুলোর কোনো না কোনো ইস্যুতে বিজয় দরকার। সরকারের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তার নেওয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সব দলকেই একসঙ্গে ‘বিজয়ী’ করা। কিন্তু দলগুলোর চাওয়া ও দাবি মধ্যে যেহেতু পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে, তাই এক দলের বিজয় মানে আরেক দলের পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। এই বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য পথ হচ্ছে সব দলেরই কিছু মানা এবং কিছু না মানা। এর সঙ্গে জনমত ও সাধারণভাবে যৌক্তিক কিছু বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার দাবিটি অবাস্তব ও অযৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আয়োজনের দিক দিয়ে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের মতোই বিস্তৃত। অল্প সময়ের মধ্যে এই গণভোট করার চেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তা ছাড়া অন্য ঝুঁকিও আছে।
সম্প্রতি এক লেখায় লিখেছিলাম, ‘গণভোটে এমনিতেই উপস্থিতির হার খুব কম থাকে, কোনো রাজনৈতিক পক্ষের বর্জনের ডাক পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে’ (সংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট, প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০২৫)। জাতীয় নির্বাচনের আগে কম ভোটারের অংশগ্রহণে যদি কোনো গণভোট হয়, তা এক বড় বিপর্যয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
এই বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের আয়োজন হবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাতে বিএনপির বিজয় হবে, কিন্তু হারবে জামায়াত। জামায়াতকে বিজয়ী করার পথ হচ্ছে উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
বিএনপির উচ্চকক্ষে পিআরের বিরোধিতা করার পেছনে যে দলের সংকীর্ণ স্বার্থ কাজ করছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চকক্ষে পিআর না হলে উচ্চকক্ষ করার কোনো যৌক্তিকতাই থাকে না। সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর নিশ্চিত করা গেলে শুধু জামায়াত নয়; এনসিপিকেও ‘বিজয়ী’ করা যাবে। এনসিপি অবশ্য শাপলা কলি প্রতীক আদায় করে এরই মধ্যে একটি ‘বিজয়’ অর্জন করে ফেলেছে। সব পক্ষের একটি মূল দাবি মেনে নিয়ে এভাবেই একটা ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি তৈরি করা যায়।
রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নিজেরা সমঝোতায় আসতে পারেনি, তাই সরকারের সিদ্ধান্তকেই এখন মেনে নিতে হবে। আর সরকারের দায়িত্ব হলো গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও জুলাই সনদ বিবেচনায় নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত দেওয়া যা সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করে তুলবে।
* এ কে এম জাকারিয়া, প্রথম আলোর উপসম্পাদক
- akmzakaria@gmail.com
- মতামত লেখকের নিজস্ব

No comments