একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন কত হওয়া দরকার by মো. মাইন উদ্দিন

আপনি ধনী না গরিব, তা শুধু আপনার সম্পদের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে আপনার কাছাকাছি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সম্পদ কেমন তার ওপর। আপনি হয়তো মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনে পরমভাবে খুশি থাকবেন। কিন্তু যখনি আপনি দেখবেন, আপনার বন্ধু কিংবা পরিচিতজন আপনার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে আপনার থেকে বেশি টাকা বেতন পাচ্ছে, তখন আপনার মাথায় তুলনামূলক চিন্তা ঢুকে যাবে এবং আপনি নিজেকে গরিব ভাবতে শুরু করবেন, এমনকি আপনার চাকরির প্রতিও একধরনের বিরক্তি জন্ম নেবে।

ধরুন, আপনি বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে পরবর্তী সময়ে ওখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। এই যে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন, আপনার জন্য প্রণোদনা কী? আপনি চাকরিতে কেমন আছেন বা আপনার চাকরির সুযোগ-সুবিধা কেমন, তা জানবেন কীভাবে? প্রথম উপায় হলো আপনার ক্লাসমেটদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা। যারা আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিসিএস দিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে যোগদান করেছে, তাদের সঙ্গেই আপনি প্রথমে আপনাকে তুলনা করবেন।

চাকরির শুরুতেই এ চিন্তা না এলেও কয়েক বছর পরে আসতে বাধ্য এবং আপনি এ তুলনা করতে গিয়ে প্রথমে বড় একটা ধাক্কা খাবেন। যখন দেখবেন, সরকারি কলেজের শিক্ষকও আপনার সমান বেতন পায়, তখন আপনার মন খারাপ না হয়ে পারবে না। আপনি যখন দেখবেন, যে চাকরিতে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা প্রথম শ্রেণি (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা) তার সুযোগ-সুবিধা ওই চাকরির (যেমন বিসিএস) থেকে কম, যেখানে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণি।

আবার এই বিসিএস চাকরিতে কিছুদিন আগেও ৫৬ শতাংশ কোটা থেকে আসত, যাদের যোগ্যতা ছিল নিম্নমানের। কিন্তু তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের, যাঁরা বেশির ভাগ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এ অবস্থায় আপনি কোন বিবেচনায় নির্বিকার থাকবেন? ক্লাসে প্রথম হওয়ার গৌরব নিজের কাছেই আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাবে।

আপনার মন খারাপের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে চাকরির কয়েক বছর পর। কারণ, এ সময়ের মধ্যে আপনার বিসিএস বন্ধুদের আর্থিক অবস্থা আপনাকে ছাপিয়ে যাবে। দেখবেন, তাদের অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে সরকারি বড় বড় গাড়িতে চড়ে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে আবার ব্যক্তিগত গাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যাবে। আপনি ভালো করেই জানেন, তাদের এত টাকাপয়সা কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারবেন না। তাহলে সমাজ ভাববে, আপনি তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। আপনি তো শিক্ষক, আপনার অত টাকাপয়সা দরকার নেই। শুধু সালাম পেলেই চলবে। ঈর্ষান্বিত হওয়া তো যাবেই না।

আরও মন খারাপ হবে যখন দেখবেন, এ রকম একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে আপনার আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী অপছন্দের পরিবর্তে সমীহ করছে। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে দেখবেন, অনেকেই তার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার অনুপস্থিতি কেমন যেন সবাই অনুভব করছে। দেখবেন, এ রকম দুর্নীতিবাজ লোকের কাছ থেকে অনেকেই নানা রকম সুবিধা নিচ্ছে। বিভিন্ন উৎসবে তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে দারুণ খুশি হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা এখন পড়াশোনা করছে, তারা তাকেই আইকন হিসেবে দেখছে এবং ভবিষ্যতে তার মতো হওয়ার স্বপ্ন বুনছে।

একটা সময় ছিল যখন সরকারি চাকরিজীবীরা দুর্নীতি করলেও চাকরিকালে তার প্রকাশ খুব বেশি দেখা যেত না। আবার এত বেশিসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও ছিল না। গত দেড় দশকে সরকার আমলাদের সুবিধা অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে যে রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। কোনো কোনো ক্যাডারে দুর্নীতি না করা কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। এসব ক্যাডারে চাকরির ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে কর্মকর্তারা অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। এসব অসৎ কর্মকর্তাদের সম্পদের পাহাড় সৎ কর্মকর্তাদের ওপরে একধরনের চাপ তৈরি করে। একই সমাজে বসবাসের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনেও এর প্রভাব এসে পড়ছে।

তুলনীয় চাকরির সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে, এমন উৎসগুলো যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যেমন একজন ডিসির যেহেতু জেলার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, তাই তার জন্য একটা বড় গাড়ির দরকার হতে পারে। কিন্তু কোন বিবেচনায় অসহনীয় যানজটের এ ঢাকা শহরে আজিমপুর থেকে সচিবালয়ে যেতে একজন কর্মকর্তার জন্য ঢাউস সাইজের একটা গাড়ি বরাদ্দ করতে হবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষক যদি একটা মিনিবাসে করে উত্তরা থেকে তাঁদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসে আসতে পারেন, তাহলে আমলাদের একই রকম বাসে করে অফিসে যেতে সমস্যা কোথায়? আবার ঢাকা মেডিকেলের একজন ডাক্তারকে যদি সাত দিন আগে রিকুইজিশন দিয়ে একটা গাড়ি পেতে হয়, আর সে রকম যোগ্যতার একই ডাক্তার যখন কোনো বাহিনীতে চাকরি করে দেখেন, তাঁর জন্য দুটি গাড়ি বরাদ্দ থাকে, তাহলে ঢাকা মেডিকেল তাঁর কাছ থেকে ভালো সেবা পাবে না। গাড়িকে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে না দেখে প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করলে বেতন–বৈষম্যের উৎসও কমে যাবে। বড় গাড়ি মানে বেশি মর্যাদা, বেশি ক্ষমতা—এ নিচুতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের জন্য বেতন–বৈষম্য দূর করা জরুরি। সমযোগ্যতার চাকরির ক্ষেত্রে এ বৈষম্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, যা সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও কর্মক্ষেত্রে অবদান বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের সামগ্রিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানকে বিবেচনায় নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি বুয়েট, মেডিকেলও এ দেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। একইভাবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, টাকাই মানুষের ব্যবহার পরিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক নয়। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কারণ, টাকার ঘাটতি কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। বর্তমান বেতনকাঠামোয় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পক্ষে সচ্ছল জীবনযাপন সম্ভব নয়। তাই তাঁরা কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কোর্স পড়ান। একসময় কেউ কেউ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও পড়াতেন। একমাত্র আর্থিক কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরি ছেড়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যোগদান করেছেন। এ রকম আর্থিক অনটন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম সান্ধ্যকোর্স চালু হয়েছে, যেখানে অনেক নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। কাউকে আর্থিক সংকটে রেখে তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না।

একটি ন্যায়ভিত্তিক বেতনকাঠামো নির্ণয়ে আর্থিক ও প্রকৃত মজুরির পার্থক্য বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার যখন আমলাদের গাড়ি–সুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, চালকের বেতন ও গৃহকর্মীর ভাতা প্রদান করে, তখন তাঁদের প্রকৃত মজুরি আর্থিক মজুরিকে ব্যাপকভাবে ছাপিয়ে যায়। আবার এই গাড়ি যখন অফিসবহির্ভূত কাজ, যেমন দৈনন্দিন বাজার করা, সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত, বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গমনাগমনে ব্যবহৃত হয়, তখন প্রকৃত মজুরি আরও অনেক বেড়ে যায়। যদি মাসে ভাতাসহ কয়েকটি মিটিং থাকে, তা–ও প্রকৃত মজুরিকে বাড়িয়ে দেয়। অথচ এ রকম জীবনযাপনের জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বাড়তি প্রতিটি টাকা অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে আয় করতে হয়।

এ বাড়তি মজুরির সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য কেউ কেউ আমলা হয়েছেন বলে তাঁদের মুখ থেকেই শুনেছি। তবে তাঁরা বেশির ভাগই চাকরি জীবনে সৎ ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল কম।

এ অপশাসনের দেশে ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকলে একদিকে যেমন দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়, তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক হয়রানি থেকেও মুক্ত থাকা যায়। এখন এ ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন ডাক্তার ও প্রকৌশলীরা। দুর্নীতি তো করছেনই। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমানো গেলে বিসিএসের কয়েকটি ক্যাডারের প্রতি যে সীমাহীন মোহ, তা কেটে যাবে। এসব ক্যাডার চাকরির বাজারে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, তা–ও অনেকটা কমে আসবে।

আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে একজন শিক্ষক ও আমলা যখন একই সঙ্গে বাজারে উপস্থিত হন, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যেন বড় পার্থক্য না থাকে। পার্থক্যের উৎসগুলো বিবেচনায় নিয়ে বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক উৎস ছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি। এখনই সময় সমযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রকৃত বেতন-বৈষম্য দূর করা। যদি তা করা না হয়, তাহলে এ প্রজন্ম, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে, চাকরিতে ঢুকে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবশ্যই রুখে দাঁড়াবে। নতুন পে কমিশন এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন বলে আশা করছি।

* ড. মো. মাইন উদ্দিন, অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়
- (মতামত লেখকের নিজস্ব)

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-08-23%2Fdxfh1wzw%2Fjjjoo.JPG?rect=0%2C0%2C616%2C411&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif

No comments

Powered by Blogger.