দাসপ্রথা বিলোপে দাসদের কি কোনো ভূমিকা ছিল by মো. মিন্টু হোসেন

লাখো আফ্রিকানকে বন্দি করে অমানবিক পরিশ্রমে বাধ্য করা হয়েছিল দাসপ্রথায়। ১৭৯১ সালের হাইতির বিদ্রোহ ও ব্রিটেনে আন্দোলনের জোরে ১৮০৭ সালে আইন পাস হয়, ১৮৩৮ সালে দাসরা মুক্তি পায়। আজও মানব পাচার আধুনিক দাসত্বের রূপ।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ২৩ আগস্ট পালিত হয় দাস–বাণিজ্য বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। দাস–বাণিজ্য ইতিহাসের এমন এক সময়কে নির্দেশ করে, যখন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে সম্পূর্ণ বৈধভাবে কেনাবেচা করা হতো। আটলান্টিক মহাসাগর ঘিরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক পথে লাখ লাখ মানুষকে দাস হিসেবে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো।

কিন্তু ১৭৯১ সালের ২২ থেকে ২৩ আগস্টের রাতে সান্তো দোমিঙ্গোতে (আজকের হাইতি ও ডোমিনিকান রিপাবলিক) যে বিদ্রোহ শুরু হয়, সেটি দাস–বাণিজ্য বিলোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জাতিসংঘের নেতৃত্বে দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার মাধ্যমে পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো মানব ইতিহাসের এই লজ্জাজনক অধ্যায়কে মনে করিয়ে দেওয়া এবং মানুষকে সচেতন করা।

দাস–বাণিজ্যপ্রথা কী

দাস–বাণিজ্যের ইতিহাস অনেক ভয়াবহ। ১৫০০ সালের দিক থেকে দাস কেনাবেচার মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করা হতো। যুক্তরাজ্যের লন্ডন, লিভারপুল, ব্রিস্টলসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে দাসবাহী জাহাজ পশ্চিম আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা করত। এসব জাহাজে থাকত কাপড়, অস্ত্রসহ নানা সামগ্রী, যা দাস ব্যবসার বিনিময়ে ব্যবহৃত হতো।

এসব সামগ্রীর বিনিময়ে অপহৃত নারী, পুরুষ ও শিশুকে কেনা হতো। আবার অনেক সময় আফ্রিকার স্থানীয় শাসক বা প্রধানদের কাছ থেকেও দাস ক্রয় করা হতো।

ফলাফল ছিল ভয়াবহ—লাখ লাখ পরিবার ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। এরপর বন্দীদের দাসবাহী জাহাজে গাদাগাদি করে মাসের পর মাস সমুদ্রপথে যাত্রা করানো হতো। এই পথকে বলা হতো মিডল প্যাসেজ। ভয়াবহ দুরবস্থার কারণে এই যাত্রাপথেই বহু মানুষ মারা যেত।

গবেষকেরা মনে করেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে দাস ব্যবসায় কমপক্ষে ২ কোটি ৪০ লাখ আফ্রিকানকে বিক্রি করা হয়েছিল।

দাসদের নিলাম ও শোষণ

ক্যারিবীয় অঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তুলে নেওয়া আফ্রিকানদের নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করা হতো। এরপর তাঁদের কোনো মজুরি ছাড়াই বিশাল কৃষিভূমি বা গাছ রোপণের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। সেখানে তাঁরা আখ, কফি প্রভৃতি ফসল উৎপাদনে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতেন।

এই মানুষগুলোর কোনো অধিকার ছিল না। বরং তাঁদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হতো। দাসদের উৎপাদিত পণ্য যেমন চিনি, কফি ও তামাক জাহাজে করে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে সেগুলো বিক্রি করা হতো।

এই বাণিজ্য থেকে অসংখ্য মানুষ বিপুল ধনী হয়ে ওঠে। আর এই দাস ব্যবসা ব্রিটেনের অর্থনীতিতেও বিশাল লাভ এনে দেয়।
দাসদের জীবনযাপন ও দুর্বিষহ বাস্তবতা

দাস হিসেবে জীবন ছিল অকল্পনীয় কষ্টকর। আজকের দিনে সেটি কল্পনা করাও কঠিন। অধিকাংশ দাসের কোনো অধিকারই ছিল না। অনেককে নিজের নাম পরিবর্তন করে মালিকের দেওয়া নাম নিতে বাধ্য করা হতো।

দাসদের দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অমানবিক পরিবেশে খাটতে হতো। খাবার ছিল অপ্রতুল ও নিম্নমানের, কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। অনেক সময় প্রচণ্ড গরম রোদে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো, তাঁরা থাকতেন জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে এবং ঘুমাতেন কাদামাটির মেঝেতে।

দাসদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মালিকেরা শারীরিক সহিংসতাও অবলম্বন করতেন। কোনো দাস একবার মাঠে কাজ শুরু করলে অমানবিক পরিশ্রমের কারণে তাঁদের আয়ুষ্কাল উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেত। সংক্ষেপে, দাস হওয়া মানেই ছিল এক কঠিন, শোচনীয় ও দুর্দশাগ্রস্ত জীবন।

দাস ব্যবসা কীভাবে বিলুপ্ত হলো

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটেনে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। প্রথম দিকে ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠী, যেমন কোয়েকাররা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।

মানুষেরা দাসপ্রথাকে সমর্থন না জানাতে চিনির ব্যবহার বন্ধ করতে শুরু করে। কারণ, আখের চাষে দাসদের ওপর নির্যাতন চালিয়েই এসব চিনি উৎপাদিত হতো।

থমাস ক্লার্কসন টানা সাত বছর ধরে ঘোড়ায় চড়ে প্রায় ৩৫ হাজার মাইল ভ্রমণ করে ব্রিটেনজুড়ে জনসমর্থন সংগ্রহ করেন। ১৭৮৭ সালে তিনি এমপি উইলিয়াম উইলবারফোর্সকে রাজি করান পার্লামেন্টে দাস ব্যবসা বন্ধের দাবি উত্থাপন করতে।

একই সময়ে দাসরাও নিজেদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ওলাউদাহ ইকুইয়ানো—একজন সাবেক দাস, যিনি নিজের স্বাধীনতা কিনে নিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে একটি বেস্টসেলার বই প্রকাশ করেন, যা দাসপ্রথার ভয়াবহতা সবার সামনে তুলে ধরে।

অবশেষে ১৮০৭ সালে ২৫ মার্চ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘দাস ব্যবসা বিলুপ্তি আইন’ পাস করে। এ আইনে বলা হয়, কোনো ব্রিটিশ জাহাজে দাস পাওয়া গেলে প্রতি দাসের জন্য জাহাজমালিককে ১০০ পাউন্ড জরিমানা দিতে হবে। সেই সময় এত বড় অঙ্কের জরিমানা ছিল কার্যত ব্যবসা ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কঠোর শাস্তি।

দাস ব্যবসা আইন করে বন্ধ হওয়ার পরও দাসপ্রথা একেবারে হঠাৎ শেষ হয়নি। প্রথমে দাসদের মুক্তি দেওয়া হলেও তাঁদের অনেককে জোর করে পাঁচ বছরের জন্য শিক্ষানবিশ ব্যবস্থায় আবার সাবেক প্রভুদের অধীন কাজ করানো হতো।

অবশেষে ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা থেকে আসা সব দাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে তখনো দাসপ্রথা চলতে থাকে।

মুক্তি পেলেও দাসরা এত বছরের বিনা মজুরির কাজের কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। বরং আশ্চর্যের বিষয় হলো, দাসদের মালিকদের ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়া হয়েছিল।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক্সেটারের বিশপ তাঁর ৬৬৫ জন দাস ‘ত্যাগ’ করে প্রায় ১২ হাজার ৭০০ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। সেই অর্থ আজকের দিনে হলে অঢেল সম্পদের সমান হতো।

আজও কি দাসপ্রথা আছে

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজও পৃথিবীর কিছু অপরাধী মানুষকে দাস বানিয়ে রাখে। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। এমন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা ধরা পড়লে আদালতে বিচার হয় এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধের মতোই শাস্তি দেওয়া হয়।

আজকের দিনে মানুষকে জোরপূর্বক অন্য জায়গায় কিংবা অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে ব্যবহার করাকে মানব পাচার বলা হয়।

এটাই মূল পার্থক্য, ঐতিহাসিক দাস ব্যবসা একসময় বৈধ ছিল, কিন্তু আধুনিক দাস ব্যবসা আজ সম্পূর্ণ বেআইনি।

দাসদের অধিকার: অতীত ও বর্তমান

অতীতে অধিকাংশ দাসের কোনো অধিকারই ছিল না। কিন্তু এখনকার দাসপ্রথার সঙ্গে তার বড় পার্থক্য রয়েছে। আজকের দিনে যদি কাউকে জোরপূর্বক খারাপ পরিবেশে আটকে রাখা হয় এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হয়, তবে তাঁরও অন্য সবার মতোই অধিকার আছে। কেউ পালিয়ে আসতে পারলে পুলিশ তাঁকে সুরক্ষা দেবে।

কিন্তু ঐতিহাসিক দাস ব্যবসায় পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন যদি কোনো দাস পালিয়ে যেতেন, পুলিশ বরং তাঁকে আবার প্রভুর কাছে ফিরিয়ে দিত। এরপর সেই দাসকে অবাধ্যতার শাস্তি পেতে হতো।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, ইউনেসকো

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-08-23%2Fjwlu7e9m%2Fchild.jpg?rect=46%2C0%2C503%2C335&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এখনো দাসপ্রথার মতো বিষয়টি চালু আছে। ছবি : রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.