অভ্যুত্থানের পর যে রূপ নেয় গণভবনের অন্দরমহল by মানসুরা হোসাইন
গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা দেড় দশকের আবাসস্থল গণভবনে গত ২ জুন গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। তীব্র গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা গত বছর ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গণভবনে ঢোকে জনতার স্রোত। বিপুলসংখ্যক মানুষ বিশাল আয়তনের গণভবনে ইচ্ছেমতো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ভাঙচুরে অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। সেই সঙ্গে চলে লুটপাট। সেদিন লোকজন গুরুত্বপূর্ণ নথি থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যবহৃত শাড়ি, তৈজসপত্র, পুকুরের মাছ, রান্না করা খাবার—সবই লুট করে নিয়ে যায়।
এই গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিন গত ৫ আগস্ট গণভবনে জাদুঘর তৈরির কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জাদুঘরটি এখনো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ গণভবনের দায়িত্ব নিয়ে জাদুঘর তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়ায় সেখানে সাধারণের প্রবেশের সুযোগও গত কয়েক মাসে ছিল না।
এর মধ্যে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অনুমতি নিয়ে গত ২ জুন গণভবনে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যায়। সর্বশেষ দেখা সেই চিত্রই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। গণভবনে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। সেখানকার সুইচ বোর্ড পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছিল। ভবনের অনেকগুলো কক্ষে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। বড় করে গণভবন লেখা বোর্ডটিও কেউ একজন সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।
সেদিন গণভবনের ভেতরে দেখা যায়, শেখ হাসিনার চিকিৎসা–সংক্রান্ত এক্স-রে ফিল্ম, এক্সক্লুসিভ সিরিজের স্টারলিং হাই কোয়ালিটি শটগান শেলের প্যাকেট, কোভিড–১৯–এর পরীক্ষার কার্ড, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনের আমন্ত্রণপত্র, জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা ২০২৪ এর রসিদ, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের জন্য একজনের পূরণ করা মেম্বারশিপ অ্যাপ্লিকেশন ফরম, শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তির একটি কার্ড, আমার দেখা নয়া চীন-এর ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠা, এইচ টি ইমামের পত্রিকায় লেখা হৃদয়বিদারক ১৫ আগস্ট, গদি ছাড়া চেয়ার, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের খালি প্যাকেট, ২০১৩ সালে ডিজিএফআইয়ের পাঠানো একটি খালি প্যাকেট, ২০২৩ সালের মহান বিজয় দিবসের ডাকটিকিটের লিফলেট, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বানানো সিনেমার জন্য কাগজে লেখা ১৯৭৩ সালের দৃশ্যচিত্র—বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপের কপি, শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের ২০১৭ সালের এমআরআই রিপোর্টের প্যাকেট, শটগান ক্লিনিং প্যাকেট, অটিজম ও স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা–বিষয়ক কমিটিসহ আরও কিছু কাগজ, দাওয়াতপত্র, লাল মলাটে ইকবালের কবিতা, সাংবাদিকদের ভিজিটিং কার্ড, শেখ হাসিনার ভিজিটিং কার্ড এদিক–সেদিক থেকে উঁকি দিচ্ছে। লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর স্নাতকের রিপোর্ট কার্ড, সাদা–কালো অস্পষ্ট একটি পারিবারিক ছবি থেকে এখন আর সেগুলোর ইতিহাস বের করা সম্ভব না। ভবনের একটি কক্ষে দেখা গেল শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি দিয়ে একটি লিফলেটে লেখা, লক্ষ্য এবার স্মার্ট বাংলাদেশ।
ভবনের এক জায়গায় দেখা যায়, লেমিনেটিং করা পুড়ে যাওয়া লাশের একটি ছবি। ছবির ক্যাপশনে লেখা, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জামায়াত-বিএনপির দেওয়া আগুনে মারা যায় বাসের হেলপার তোফাজ্জল হোসেন। হল রুমের তিনটি ঝাড়বাতি আস্তই ঝুলছিল। এটুকু দিয়ে গণভবনের অতীত জৌলুশের চিত্র যেন কিছুটা উঁকি দিচ্ছিল।
গণভবনের বিভিন্ন দেয়ালে বিক্ষুব্ধ লোকজন তাঁদের মনের কথা লিখে রেখে যান। শেখ হাসিনা খুনিসহ বিভিন্ন গালিও আছে তাতে। এক জায়গায় লেখা, ‘কিছু বললেই স্বজনহারা বেদনা শুরু হয় ডাইনির’। গণভবনের কয়েকটি কক্ষের দেয়াল সুন্দর করে রং করা। এই দেয়ালগুলোতে হাতে আঁকা গাছ ও পাখিও আছে। তেমনই একটি দেয়ালে লেখা হয়েছে, ‘জয় গণতন্ত্র ২০২৪’।
কুড়িয়ে পাওয়া একটি নোটে লেখা দেখা যায়, ‘জয় মামাকে সাধারণ খাবার দিতে হবে। পরোটা বানানো নিষেধ। সবজি, মুরগি, ডাল দিতে হবে। গরু ও খাসি কম।’ সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের খাবারের মেনুতে এই নোটটিতেই রুই মাছ, ইলিশ মাছ ভাজি, ভর্তা দুই রকম, কাচ্চি বিরিয়ানির কথা লেখা। আর ইলিয়াছ মোল্লার জন্য মেনুতে কই মাছ, শিং মাছ, শোল মাছ, টাকি মাছের কথা লেখা। মামির সালাদে টমেটো দেওয়া যাবে না— লেখা ছিল নোটটিতে। এটি কবেকার, তার তারিখ ছিল না।
৫ আগস্ট অনেকে গণভবনের লেকে নেমে গোসল করে। এই লেকের সংস্কারকাজের ফলকটি আস্তই ছিল। তাতে লেখা, গণভবনের লেক পুনঃখনন ও সংস্কার—লেকের বড় অংশের দৈর্ঘ্য ৩৭৬ দশমিক ১০ মিটার, প্রস্থ ১৮ দশমিক ৬০ মিটার। আর লেকের ছোট অংশের দৈর্ঘ্য ১০০ দশমিক ০০ মিটার এবং প্রস্থের মাপ লেখা ৬ দশমিক ৪০ মিটার। ২০১৪ সালে এ কাজটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন।
৫ আগস্ট গণভবনের একটি জার্মান শেফার্ডকে সঙ্গে করে নিয়ে যান একজন। পরে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে কুকুরটি উদ্ধার করে নিজের কাছে রাখেন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০২৩ ’-এর মুকুটজয়ী শাম্মী ইসলাম (নীলা)। তবে ফেসবুকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য দেখে শাম্মী ইসলাম গণভবনে গিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে কুকুরটিকে ফেরত দিয়ে আসেন। তবে এ কুকুর এখন কোথায় আছে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
গণভবন থেকে লুট করা একটি সিন্দুক মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার বটতলা এলাকা থেকে উদ্ধার করেছিল র্যাব। এতে ৮ লাখ টাকা ছিল। পরে অবশ্য কেউ কেউ লুট করে নিয়ে যাওয়া কিছু জিনিস সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত দিয়ে যান। তবে এসব জিনিসপত্র এখন কোথায় বা কার কাছে আছে, তা–ও জানা নেই জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের। দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ গণভবনের ধ্বংসস্তূপে যে অবশিষ্ট আসবাব বা অন্যান্য জিনিস পেয়েছিল তাতে নম্বর বসিয়েছে হিসাব রাখার জন্য।
গণভবন সম্পর্কে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৮ একরের বিশাল কমপ্লেক্স, উন্মুক্ত মাঠসহ ২৯ হাজার বর্গফুটের বিশাল দ্বিতল ভবনটিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দাপ্তরিক কাজও হতো এখানে। গণভবনের খোলা জায়গায় নানা শাকসবজি, ফল এমনকি বিভিন্ন জাতের ধানের চাষও করতেন শেখ হাসিনা। বিশাল লেকে মাছ চাষ করতেন। গরু, মুরগি, কবুতরসহ নানা জাতের পশুপাখি পালন করতেন। এ ছাড়া বিনোদনের জন্য ছিল বিশাল টেনিস কোর্ট। ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার দিন দুপুরের আগপর্যন্ত শেখ হাসিনা গণভবনেই ছিলেন। তাঁর জন্য সেদিনের খাবারও তৈরি ছিল।
জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে কী কী থাকছে
২ জুন সরেজমিনে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ গোলাম নাফিজের দেহ বহনকারী রিকশাটি একটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। জাদুঘরে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখা হবে এটি। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর ফার্মগেটের পদচারী-সেতুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয় নাফিজ। নাফিজ রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।
গত ৫ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘নাফিজের নিথর দেহ পড়ে থাকা রিকশাটি বিক্রি করে দিয়েছেন নুরু’ শীর্ষক ভিডিও প্রতিবেদনটি দেখে তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাৎক্ষণিক রিকশাটি জাদুঘরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অন্য শহীদদের স্মারকগুলোও সংগ্রহ করছে সরকার।
বিশ্বের আধুনিক জাদুঘরের আদলেই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তাঁর ভাষ্যমতে, এই জাদুঘর গল্প বলবে। মানুষ জানতে পারবে কীভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তারা কী কী করেছে, কী কী করার ফলে মানুষ ফুঁসে উঠেছে এবং শেখ হাসিনাসহ নেতারা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, ‘গণভবনটা তো ছিল আসলে একটা বাড়ি। যে বাড়িতে খুনি থাকতেন এবং এখানে বসে উনি পরিকল্পনা করতেন, মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিতেন। অনেককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতেন, গুম করতেন, হত্যার নির্দেশ দিতেন, ব্যাংক লুট করতেন এবং যাবতীয় অপকর্মের কেন্দ্রস্থল ছিল এটা।’
ইতিহাসের বাঁকবদলের সাক্ষী
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রেসিডেন্ট ভবনে অফিস করতেন। প্রেসিডেন্ট ভবন তখন গণভবন নামে পরিচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট ভবনে স্থান সংকুলান হতো না। ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও সচিবালয় হিসেবে শেরেবাংলা নগরে এই গণভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট থাকাকালে গণভবনে বসবাস না করলেও ভবনটিকে অফিসের কাজে ব্যবহার করতেন।
১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেন। ১৯৮৬ সালে এটিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পরিণত করা হয়, নাম দেওয়া হয় করতোয়া ভবন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তখন তিনি গণভবন বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০১ সালের ২০ জুন জাতীয় সংসদে ‘জাতির পিতার পরিবারের সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০১’ সংসদে পাস হয়। বছরটির ২ জুলাই শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে শেখ হাসিনার নামে গণভবন বরাদ্দ বাতিল করার দাবি জানান। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বছরটির ১৬ আগস্ট শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে যান।
পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের জন্য জাতির পিতার পরিবারের সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন পাস করে। ২০১০ সালের ৫ মার্চ থেকে আবারও গণভবনে থাকতে শুরু করেন শেখ হাসিনা, ছিলেন গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
গণভবন নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্ক হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাম পরিবর্তন হয়েছে আবার গণভবন নামটি ফেরতও পেয়েছে। জাদুঘর করা হলে আবার কোনো সরকার ক্ষমতায় এসে তা পাল্টে ফেলবে কি না—এমন প্রশ্নে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে এবং সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে জুলাই এসেছে, তা সবার চোখের সামনে ঘটেছে। তথ্যপ্রমাণ সবার হাতে আছে। ফলে এবারের ইতিহাস বদলে ফেলার কোনো সুযোগ নেই।’
No comments