ইসরায়েলের আগ্রাসন কীভাবে মোকাবিলা করবে তুরস্ক by মুরাত ইয়েসিলতাস

বাশার–আল–আসাদের শাসন অবসানের পর তুরস্ক যে কৌশলগত সুবিধা পেয়েছিল, তা তারা সতর্ক পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে কাজে লাগিয়েছে। তুরস্কের এই কৌশলকে কূটনৈতিক আপস হিসেবে বর্ণনা করা যায়।

তুরস্ক তাদের এই নতুন সিরিয়া নীতি ‘আঞ্চলিক মালিকানা’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে দাঁড় করায়। তুরস্কের সিরিয়া নীতির কেন্দ্রে রয়েছে ইস্যু কুর্দি পিপলস প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি)। এরপরও তুরস্ক ওয়াইপিজিকে নিয়ে তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে দামেস্কের সঙ্গে সংগঠনটির সমঝোতার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।

তুরস্কের লক্ষ্য হলো একদিকে সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা, অন্যদিকে ওয়াইপিজির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা ঠেকানো। এই ফাঁকে ওয়াইপিজি দামেস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করার জন্য সময় পায়। এতে তারা আঙ্কারা ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সামরিক চাপ এড়াতে সক্ষম হয়।

সিরিয়ায় ইসরায়েলের আগ্রাসী অবস্থানের ক্ষেত্রেও আঙ্কারা একই ধরনের আপসকামী নীতি নেয়। নতুন দামেস্ক প্রশাসনকে দুর্বল করা ও সিরিয়ার ভেতরে নিজেদের প্রভাববলয় বাড়ানোর ইসরায়েলি উদ্যোগের মুখে তুরস্ক কূটনৈতিক আলোচনা ও গোয়েন্দাপ্রক্রিয়া সক্রিয় করে। সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়িয়ে কৌশলী আলোচনার পথ বেছে নেয়।

এই সময়ে ইসরায়েল সিরিয়ার নতুন সরকারের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করে, গোলান মালভূমিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করে এবং দক্ষিণের দ্রুজ জনগোষ্ঠীকে ‘রক্ষা’র নামে দামেস্কে প্রতীকী বিমান হামলা চালায়।

কিন্তু এখন ইসরায়েল ও ওয়াইপিজির সঙ্গে তুরস্কের আপসের এই কৌশল আর কাজ করছে না।

সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সরাসরি নিজেদের প্রভাববলয় গড়ে তুলতে চাইছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো তুরস্ককে অঞ্চলটি থেকে বের করে দেওয়া এবং দামেস্ক সরকারকে দুর্বল করে দিয়ে একটি অস্থিতিশীল সিরিয়া তৈরি করা। সুয়েইদাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সিরিয়ার ভেতরে গড়ে তোলা তুরস্কের নিরাপত্তাকাঠামোর প্রতি হুমকি তৈরি করছে।

সিরিয়া এখন তুরস্ক ও ইসরায়েলের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন মঞ্চ। এ অবস্থায় ইসরায়েলের আঞ্চলিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আরও সুস্পষ্ট প্রতিরোধমূলক অবস্থান না নিলে তুরস্কেরর পক্ষে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কঠিন বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েল চায় সিরিয়ার আকাশসীমায় পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে।

অন্যদিকে তুরস্ক এ ব্যাপারে সজাগ যে ইসরায়েলের এই হস্তক্ষেপ ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো দামেস্ক প্রশাসনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। কিন্তু আঙ্কারা ও দামেস্কের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে এবং ‘ঘাঁটিসংক্রান্ত চুক্তি’ হলে সেটিকে ইসরায়েল ‘লাল রেখা’ বলে ঘোষণা করেছে। তবে এই তথাকথিত লাল রেখা প্রকৃতপক্ষে যতটা বাস্তব প্রতিরোধ, তার চেয়ে বেশি কৌশলগত ভাঁওতাবাজি। এর কারণ হলো, ইসরায়েল যদি সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায়, তবে সেটি আঙ্কারাকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে নেওয়ার সমান হবে। তুরস্ক যদি দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তেল আবিব বা ওয়াশিংটন—কেউই ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

সিরিয়ায় ইসরায়েলের নীতি শুধু দক্ষিণ সিরিয়ায় দ্রুজ সম্প্রদায়কে হাতিয়ার বানিয়ে নতুন প্রভাববলয় তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ওয়াইপিজিও দেশটির এই সমীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসরায়েল চাইছে ওয়াইপিজি ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার মাটিতে তুরস্কের কৌশলগত অবস্থানকে সংকুচিত করে দিতে।

এই কৌশল এখন কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসরায়েল ব্যবহার করছে। ওয়াইপিজিকে পরোক্ষ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের তুরস্কের ‘লাল রেখা’ অতিক্রমের পথে নিয়ে যেতে চাইছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো ওয়াইপিজি ও দামেস্কের মধ্যে সম্ভাব্য কোনো সমঝোতা ঠেকানো, তুরস্কের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা দুর্বল করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া নীতি তুরস্কবিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দেওয়া। অভিযোগ আছে, ওয়াশিংটনে তুরস্কের অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল কূটনীতিকদের সরিয়ে দিয়ে ইসরায়েল–ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বসাতে চাপ দিয়েছে তেল আবিব।

অন্যদিকে তুরস্ক ওয়াইপিজি ইস্যুতে স্পষ্ট একটি কৌশলগত সীমারেখার নীতি অনুসরণ করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তুরস্ক ওয়াইপিজিকে নির্দিষ্ট সময় দিয়েছে এবং সে সময়ের মধ্যে সংগঠনটির দামেস্কের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর আশা করছে।

যদি এই প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তবে তুরস্ক স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে সামরিক বিকল্পটি তারা আরও জোরদারভাবে ব্যবহার করবে। এর অর্থ হচ্ছে, ওয়াইপিজি যাতে শান্তিপূর্ণ পথে নিজেদের রূপান্তর করতে পারে, সেটাতেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে তুরস্ক, কিন্তু প্রয়োজনে ওয়াইপিজিকে সামরিকভাবে দুর্বল করার বিকল্পও ভেবে রেখেছে।

তুরস্কের জন্য ওয়াইপিজি ইস্যুটি এখন শুধুই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুও।

এখন ইসরায়েলের আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য তুরস্কের প্রয়োজন আরও সক্রিয় একটি কৌশল। দামেস্কের সঙ্গে সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা শক্তিশালী করা, আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতি গভীর করা এবং ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আগেই ওয়াইপিজিকে অন্তর্ভুক্ত বা নিষ্ক্রিয় করা—এই তিনটি কৌশলের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।

* মুরাত ইয়েসিলতাস, তুরস্কের সিএটিএ ফাউন্ডেশনের নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা বিভাগের পরিচালক
- মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.