বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌন সম্পর্ক: ধর্ষণের নতুন ধারায় ৪ মাসে ২১০ মামলা by নাজনীন আখতার

সরকারি একই দপ্তরে চাকরির সুবাদে ২০২২ সালে দুজনের পরিচয়। এক বছর পর দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নারীর অভিযোগ, বন্ধুর বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাঁকে ধর্ষণ করেন সহকর্মী প্রেমিক। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। সবশেষ নারী বিয়ে না করলে ঘটনা সবাইকে বলে দেবেন বলে হুমকি দেন। তখন প্রেমিক তাঁকে রংপুরে নিজের গ্রামের বাড়ি আসতে বলেন।

নারীর ভাষ্য, প্রেমিকের কথামতো তিনি গত ২ এপ্রিল রংপুর শহরে যান। প্রেমিকের পরিবারের সদস্যরা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন সকালে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। রাতে প্রেমিক শহরের একটি আবাসিক হোটেলে নারীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে কক্ষ ভাড়া করেন। আবার যৌন সম্পর্ক করেন। পরদিন নাশতা কেনার কথা বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রেমিক আর ফিরে আসেননি। এই অবস্থায় নারী তাঁর প্রেমিকের গ্রামের বাড়ি গিয়ে বিয়ের দাবিতে অনশন করেন চার দিন। ১৫ দিনের মধ্যে পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়ে তাঁকে ফেরত পাঠান প্রেমিকের পরিবারের সদস্যরা।

তবে প্রতিকার না পেয়ে গত ২২ এপ্রিল রংপুরের তাজহাট থানায় প্রেমিককে আসামি করে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ করেন নারী। থানা-পুলিশ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ ’-এর ৯খ ধারায় অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।

অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের ২৫ মার্চ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে। আইনের ধারা ৯ক-এর পর নতুন ধারা ৯খ সংযোজন করা হয়েছে। ৯খ ধারায় ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ করলে দণ্ডের বিষয়ে বলা আছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, নতুন এই ধারা কার্যকরের পর গত জুলাই মাস পর্যন্ত চার মাসে সারা দেশে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ করার অভিযোগে ২১০টি মামলা হয়েছে।

আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। আর বিয়ের প্রলোভনে যৌনকর্ম করার দণ্ড সর্বোচ্চ ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।

রংপুরের তাজহাট থানার মামলার এজাহারে নারী অভিযোগ করেন, ২০২৩ সালের ১২ মে থেকে ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন আসামি।

এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মামলায় কোনো অগ্রগতি আছে বলে তাঁর জানা নেই। তবে তিনি ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।

রংপুরের তাজহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলা হওয়ার পর আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। তাঁরা মামলার অভিযোগপত্র তৈরির কাজ করছেন।

৯খ ধারায় গত ১ জুলাই রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করেন চট্টগ্রামের এক তরুণী। তাঁর ভাষ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ঢাকার বাসিন্দা এক তরুণের (২৫)। তরুণ তাঁকে ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

এজাহারে তরুণী বলেছেন, তিনি ঢাকায় এলে তাঁকে একটি হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করেন তরুণ। বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাঁকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন।

এই মামলার বিষয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে মেয়েটির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

ধর্ষণের মামলা

গত ১৪ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং অপরাধ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে। ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়।

পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে সারা দেশে ধর্ষণের মামলা হয় ৪ হাজার ১০৫টি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণের মামলা হয় ৩৯২টি। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৭টি। মার্চে ৪৮৩টি। এপ্রিলে ৫৩৭টি। মে মাসে ৫০৩টি। আর জুনে ৪৯২টি।

বছরভিত্তিক হিসাবে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২ হাজার ৭৪৪টি। ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৩৯৪টি। ২০২৩ সালে ৫ হাজার ১৯১টি। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৩২টি। ২০২১ সালে ৬ হাজার ৩৪১টি। ২০২০ সালে ৬ হাজার ৫৫৫টি।

আইনে যে কারণে নতুন ধারা

গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে মাগুরায় একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য আইনে সংশোধন আনে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংশোধনে শিশু ধর্ষণ অপরাধের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন, ছেলেশিশুদের প্রতি যৌনকর্মকে ‘বলাৎকার’ নামে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের মামলায় তদন্ত ও বিচারের সময় কমানো, ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ করার দণ্ড নামে নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। আর ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে।

অধ্যাদেশে ৯খ ধারা সংযোজন করে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করিবার দণ্ড’ রাখার বিষয়ে গত ২৮ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ধর্ষণের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, সেসব মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানে দুই ধরনের মামলা হয়। একটি হচ্ছে প্রতারণামূলক সম্মতি আদায় বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ। অপরটি কোনো ধরনের সম্পর্ক ব্যতীত ধর্ষণ, যেমন মাগুরার শিশুটির ঘটনা। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলার আধিক্য রয়েছে। এসব মামলার কারণে সম্পর্ক ব্যতিরেকে ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনার বিচার বিলম্বিত হতো। সম্পর্ক ব্যতিরেকে নৃশংস ধর্ষণের মামলার দ্রুত বিচার করতে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করিবার দণ্ড’ ধারা যুক্ত করে একে আলাদা করা হয়েছে। প্রথমোক্ত অপরাধগুলোর তদন্ত ও বিচারের সময়সীমা কমানো হয়েছে; কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের অপরাধের (‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’) ক্ষেত্রে এই সময়সীমা কমানো হয়নি, এসব অপরাধের শাস্তিরও আলাদা সাজার বিধান (সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড) রাখা হয়েছে।

একই সাক্ষাৎকারে আইন উপদেষ্টা বলেন, বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’–সংক্রান্ত ধারার মাধ্যমে নতুন কোনো অপরাধকেও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এটি ধর্ষণের প্রচলিত সংজ্ঞার মধ্যেই সুপ্ত ছিল, এমন অভিযোগে বহু মামলাও হতো আগের আইনে। পার্থক্য হচ্ছে, এখন এগুলোর বিচার নতুন বিধান অনুসারে হবে। অন্যদিকে ‘বিয়ের প্রলোভন’ ছাড়াও অন্য রকমভাবে প্রতারণা করে যৌন সম্পর্কের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা হতে পারে, সেসব অপরাধকে ধর্ষণের প্রচলিত সংজ্ঞা অনুসারে বিচার করা হবে।

‘আলাদা ধারা ইতিবাচক’

ফউজুল আজিম বলেন, ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ আলাদা ধারা হওয়ায় ভুক্তভোগী নারীরা ন্যায়বিচার পাবেন, অপরাধীরও শাস্তি হবে। আলাদা ধারা করার দিকটি ইতিবাচক। এর প্রভাব মূল্যায়ন করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে এই ধারারও অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। সাক্ষ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচারক তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে অপব্যবহার ঠেকাতে পারবেন, সেই সুযোগ রয়েছে।

নতুন ধারায়ও ‘ভুয়া মামলা’

গত ১৮ জুন রাজধানীর পল্লবী থানায় এক নারী তাঁর বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্মের’ অভিযোগে মামলা করেন। মামলাটির বিষয়ে থানা-পুলিশের ভাষ্য হলো, তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, এক ব্যক্তির সঙ্গে এই নারীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের’ মামলা করেছিলেন নারী। সেই মামলায় তিনি এই বাড়িওয়ালাকে সাক্ষী করেছিলেন। পরে আসামির সঙ্গে নারীর ‘সমঝোতা’ হয়। তখন সেই ব্যক্তির পরামর্শে নারী বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের’ অভিযোগে মামলা করেন। তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এলে নারী ‘ভুয়া মামলা’ করার বিষয়টি স্বীকার করেন। মামলাটি প্রত্যাহার করতে চান।

পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মামলা তুলে ফেলার কিছু প্রক্রিয়া আছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মামলাটিতে ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ জমা দেবে পুলিশ।

সংশোধিত অধ্যাদেশে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা হলে তা প্রতিহত করার বিধান আছে বলে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আইনের ১৭ ধারায় সংশোধন আনা হয়েছে। বিচারকের যদি মনে হয়, এটা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, সে ক্ষেত্রে বিচারক সাজা (ক্ষতিপূরণ, সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড) দিতে পারবেন।

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2021-03%2Fcfdc48ad-b728-4faf-9a73-1c8347f627de%2Fbf24ffa6-1883-4aef-bb61-e6f96698eda8.jpg?rect=88%2C0%2C630%2C420&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif

No comments

Powered by Blogger.