বিতাড়নের ভয়ে নদিয়ায় নাগরিকত্ব পাওয়ার লাইন দীর্ঘ হচ্ছে
শিবিরে উপস্থিত ৫০ বছর বয়সি মিলন রায় জানান, তিনি বাংলাদেশের পতেঙ্গা থেকে ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে’ পালিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি জানতে এসেছি কীভাবে সিএএ-এর জন্য আবেদন করতে হয়। এক আত্মীয় বলেছে, যারা বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে এসেছে, ভারত সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেবে। তিনি বলেন, একজন দালালকে টাকা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়েছেন এবং এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তিনি বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল, পরিবারের কাউকে দেখি না। আমি জীবন বাঁচাতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আরও বিপদে পড়েছি। ঠিকঠাক কাজ পাচ্ছি না, স্থায়ী আয়ও নেই। কিন্তু যদি নাগরিকত্ব পাই, তাহলে অন্তত একটা কাজ পাব এবং পরিবারকে এখানে আনতে পারব।
শিবিরে ভিড় করেছেন এমন অনেকেই কয়েক দশক আগে গিয়েছেন ভারতে। তাদের একজন রমচন্দ্র গাইন, বয়স ৫৫। তিনি জানান, ১৯৯৮ সালে স্ত্রী ও এক বছরের ছেলেকে নিয়ে ভারতে গিয়েছেন। তার ভাষায়, আমার দোকান আছে, ঘর আছে, ভোটার কার্ডও আছে। তবু এখন শুনছি যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তাদের ফেরত পাঠাবে। টিভিতে দেখেছি, দিল্লি থেকে কিছু মানুষকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তারা এখন জেলে। তাই আমি এখনই আবেদন করছি। আগে আবেদন করিনি। কারণ শুনেছিলাম, আসামের মতো এখানেও বাংলাদেশিদের আটক শিবিরে পাঠাবে। কিন্তু পরে বুঝেছি, সেটা সত্যি নয়।
বিধায়কের অফিসের বাইরে বসে ছিলেন এক তরুণ দম্পতি ও তাদের দুই বছরের সন্তান। তারা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। তারা জানান, ২০২১ সালে ছাত্র ভিসায় ভারতে গিয়েছেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। তাদের ভাষায়, আমরা খুলনা থেকে এসেছি। ওখানে আর নিরাপদ না। আমার ছেলে নিরাপদ থাকবে না। আমরা জানতাম এটা একমুখী যাত্রা, আর ফিরব না কখনও।
আবেদন প্রক্রিয়া: শিবিরে স্বেচ্ছাসেবকরা আবেদনপত্র বিতরণ করেন এবং আবেদনকারীদের তথ্য পূরণে সাহায্য করেন। তাতে নাম, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রীর নাম, পেশা, ভারতে প্রবেশের বছর ও স্থান, বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি দিতে হচ্ছে। আবেদনকারীদের বাংলাদেশি উৎস ও ভারতে বসবাসের প্রমাণপত্র দিতে হয়। প্রতিবেশীর কাছ থেকে চরিত্র সনদও লাগে। যদি স্বামী বা স্ত্রী ভারতীয় নাগরিক হন, তবে তার পাসপোর্টের কপি জমা দিতে হয়। অসিম সরকার বলেন, ২০০০ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত যাদের নাম নেই, তাদের আমরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে বোঝাচ্ছি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভুল পথে চালিত করেছেন। সিএএ হিন্দুদের জন্য, এটি আমাদের জন্য এক ‘লক্ষ্মণরেখা’। তিনি জানান, তার হরিণঘাটা বিধানসভা এলাকায় দুই মাস ধরে শিবির চলছে এবং প্রায় ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে।
স্থানীয় কিছু অধিকারকর্মী ও বাসিন্দা বলছেন, হঠাৎ আবেদনকারীর ভিড়ের পেছনে কাজ করছে ভয় ও গুজব- মিডিয়ায় প্রচারিত ‘ডিটেনশন ও ডিপোর্টেশন’-এর খবর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বিজেপি শিবিরের অভ্যন্তরীণ সূত্রে বলা হচ্ছে, এই প্রচেষ্টা মতুয়া ও অন্যান্য হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে সমর্থন শক্ত করতে সাহায্য করবে। অসিম সরকার দাবি করেন, এটি মৃত বা ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে, যদিও বিরোধীরা এই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করেন। সরকার নিজেও স্বীকার করেন, বহু আবেদনকারী আনুষ্ঠানিক নথি ছাড়াই এসেছেন।
ফলে প্রমাণ সংগ্রহে তাদের সমস্যা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের যতটা সম্ভব সাহায্য করছেন। স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। আবেদনকারীদের বলা হয়েছে রসিদ সংরক্ষণ করতে এবং সরকারি মাধ্যমে আবেদনপত্রের অগ্রগতি জানতে। তবু পালপাড়ায় লাইনে দাঁড়ানো লোকদের কাছে উদ্দেশ্য একটাই- বাংলাদেশে ফেরত না যাওয়া। রমচন্দ্র গাইন বলেন, আমি বাংলাদেশে আর ফিরতে চাই না। ওখানে আমার কিছুই নেই। আমি এখানে পরিবার নিয়ে থাকতে চাই। সরকারের কাছে আমার একটাই আবেদন- আমরা যেন এখানকার নাগরিকত্ব পাই।

No comments