কাতারে ইসরায়েলি হামলা মার্কিন বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ করে দিল by দাউদ কাত্তাব
বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেও সাজার বাইরে থাকার অভ্যাসের কারণে এখন ইসরায়েল কোনো বাধা-শর্ত দেখে কাজ করে না।
এ হামলায় অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মানুষের বিশ্বাস কমে গেছে। ইসরায়েল, যাকে বছরে কোটি কোটি ডলারের মার্কিন সহায়তা দেওয়া হয়, দেশটি এ হামলাকে কোনো লুকোছাপা ছাড়াই উদ্যাপন করেছে। এমনকি ইসরায়েলের প্রধান দলের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়ার লাপিদও বিমানবাহিনী, আইডিএফ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘অসাধারণ অভিযান’ বলেই অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইসরায়েল এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইচ্ছেমতো হামলা চালানোর মতো স্বাধীন হয়ে গেছে, যেন কারও অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্রমে কমছে। ইরাক আক্রমণের পর থেকে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা এতটা নিচে নেমে যায়নি বলেই মনে করা হচ্ছিল। দোহা হামলার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, ইসরায়েল ঠিক তাঁদেরই টার্গেট করল, যাঁরা দোহায় বসে মার্কিন প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য এসেছিলেন। ফলে আলোচনা ভেঙে গেল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেল।
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। প্রায় ৭৭ বছর আগে জেরুজালেমে জাতিসংঘের শান্তিদূত সুইডিশ কূটনীতিক ফলকে বর্নাডোটকে ইহুদি উগ্রপন্থীরা হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন। তখনকার কিছু নেতা-প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইজতজাক শামির, যিনি পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন। তাই শান্তির জন্য যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের ওপর এমন আক্রমণ নতুন কিছু না হলেও তার ক্ষতি সব সময়ই বড় ও ধ্বংসাত্মক।
ফিলিস্তিনিরা বারবার দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই ইসরায়েলকে দায়দায়িত্ব থেকে বাঁচিয়ে দেয়। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক (বাইডেন হোক বা ট্রাম্প) তারা ইসরায়েলের বোমা হামলা, সাংবাদিক বা ত্রাণকর্মীদের টার্গেট করা, যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ বা গাজার ওপর অবরোধের ঘটনাগুলোকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করেছে। এমনকি তারা ফিলিস্তিনি কূটনৈতিক কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে এবং জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে আমন্ত্রিত ফিলিস্তিনি নেতাদের ভিসাও প্রত্যাখ্যান করেছে। এসবই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ বাড়িয়েছে।
বাতিল হওয়া ওই মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি মূলত ইসরায়েলের অনুকূলে ছিল। প্রস্তাবটি অনুযায়ী, প্রথম দিনেই বাকি সব ইসরায়েলি বন্দীকে মুক্ত করা হবে এবং বদলে যুক্তরাষ্ট্র লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেবে যে তারা ইসরায়েলকে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধ শেষ করাতে চাপ দেবে। কিন্তু স্পষ্ট যে ইসরায়েলের পরিকল্পনা আলাদা ছিল। যাঁরা বন্দীদের মুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের হত্যা করলে নিজের লোকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায়ই নষ্ট হয়ে যায়।
আরও বড় সমস্যা হলো ইসরায়েলের সেই হত্যানীতি কখনো প্রতিরোধ বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। তারা বারবার হামাসের নেতাদের হত্যা করেছে, কিন্তু তাঁদের বদলে অন্যরা উঠে এসেছেন। অনেক সময় আরও কঠোর ও চরমপন্থী নেতা এসেছেন। ২০২৪ সালে হামাসের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করার পর ঠিক এমনটাই ঘটেছিল এবং সে অভিযানে অন্য দেশের সার্বভৌমত্বও লঙ্ঘিত হয়েছিল।
মানুষ আগে বিশ্বাস করত যে যুক্তরাষ্ট্র কোনো চুক্তি করলে তা বাস্তবায়ন করাতে পারবে। কিন্তু এবার দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে কাছের মিত্র ইসরায়েলকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। হামাসের যাঁরা মার্কিন প্রতিশ্রুতির সত্যতা যাচাই করছিলেন, তাঁদেরই লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালাল। এতে শুধু ওই প্রস্তাব ভেঙে গেল না, ভবিষ্যতে কোনো চুক্তি হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেল। অনেকের মতে, এটা সম্ভবত নেতানিয়াহুর নিজের সুবিধার জন্য করা হয়েছে। কারণ, যুদ্ধ শেষ হলে তাঁর রাজনৈতিক শক্তি ও ক্যারিয়ার দুর্বল হয়ে যেত।
একবার কেউ বিশ্বাস হারালে তা ফেরত আনা খুবই কঠিন। কাতার (যেখানে অঞ্চলের বড় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও আছে) ইতিমধ্যে বলেছে, তারা যদি বিশ্বাস হারায়, তাহলে তারা মধ্যস্থতা বন্ধ করে দিতে পারে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা মধ্যস্থতা করতে না পারে, তাহলে অন্য কারও পক্ষে চুক্তি করানো সম্ভব হবে না। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এমন একটি চুক্তি আনতে বিশ্বে আর কোনো একক শক্তিই যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন নয়।
ট্রাম্প হয়তো মনে করেন, বিশ্বাসযোগ্যতার বড় কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যদি অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের ওপর বিশ্বাস না করে, তাহলে আলোচনাগুলো শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে পড়ে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কেবল গাজায় নয়, বিশ্বব্যাপীও কমছে। যেমনটি ইউক্রেন সমস্যায় ‘প্রথম দিনেই’ সমাধান আনতে না পারার ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বলেছিলেন, ‘বিশ্বাস করো, কিন্তু যাচাই করো।’ অর্থাৎ চুক্তি করতে হলে কেবল কথায় বিশ্বাস নয়, তা পরীক্ষাযোগ্য হতে হবে। কিন্তু নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের সঙ্গে বিশ্বাস গড়া কঠিন। এখন একমাত্র বাস্তব পথ হলো স্পষ্ট ও যাচাইযোগ্য পদক্ষেপ—ইসরায়েলি সেনাদের গাজা থেকে পুরোপুরি ও পরীক্ষাযোগ্যভাবে প্রত্যাহার এবং বিনিময়ে ইসরায়েলি বন্দী ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি। এর চেয়ে কম কিছু হলে কেবল খালি বাক্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, কোনো ফল হবে না।
ইসরায়েল ও তার আমেরিকান–সমর্থকেরা এখন এমন এক গভীর সীমাবদ্ধতায় পড়েছে যে কেবল বক্তৃতা দিয়ে তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। প্রয়োজন বাস্তবে যাচাইযোগ্য, কার্যকর পদক্ষেপ।
● দাউদ কাত্তাব, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| কাতারের দোহায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত ব্যক্তিদের জানাজা। ছবি: এএফপি |

No comments