নয়া রাজনীতির পথে নেপাল, আলোচনায় কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র

হিমালয় কন্যা খ্যাত নেপাল আজ রাজনৈতিক ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট-এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণধর্মী সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, নেপালে পুরনো রাজনীতির অবসান ঘটেছে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা হচ্ছে। এ পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছেন কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ, যিনি তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বহু দশক ধরে নেপালের শাসনব্যবস্থা ছিল কিছু রাজনীতিবিদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে। তারা দেশকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করেছেন এবং জনগণকে দেখেছেন দাস হিসেবে। এই পুরনো প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্ব করেন কেপি শর্মা ওলি, শের বাহাদুর দেউবা, পুষ্পকমল দাহাল (প্রচণ্ড) প্রমুখ। তরুণদের উপর গুলি চালানোর মতো সহিংস দমননীতি অনুসরণ করে ওলি সরকার নিজের পতনের পথ নিজেই তৈরি করে দেয়। সোমবারের সেই বর্বর হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পদত্যাগ করেন তিনি।

সম্পাদকীয়টি বলছে, এবারের গণআন্দোলন ছিল আত্মত্যাগে ভরা, তবু গভীরভাবে সচেতন ও সংগঠিত। লাখো মানুষ রাজপথে নেমেছে। তাদের একটাই দাবি- পরিবর্তন। তারা নতুন নেতৃত্ব চায়। চায় জবাবদিহিতা ও সুশাসন। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল জেনারেশন জেড বা জেন জি। অর্থাৎ তরুণ ও নবীন নাগরিকরা। যারা পুরনো রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া তরুণরা এখন সরাসরি কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন- এসো বালেন্দ্র, আমাদের এই সংকট থেকে রক্ষা করো। ১৯৯০ এবং ২০০৬ সালের মতো বড় রাজনৈতিক পালাবদলের সময় যেমন নেতৃত্ব উঠে এসেছিল আন্দোলনের মাঝ থেকে, তেমনি এবারও বালেন্দ্র হয়ে উঠেছেন জাতির প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু।

সম্পাদকীয় মতে, নেপালের সামনে এখন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা এক ঐতিহাসিক মোড়। এই পরিবর্তনকে অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রয়োজন নতুন পরিকল্পনা, শান্তি, সংলাপ এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার রূপরেখা। এই প্রক্রিয়ায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা বাহিনী, বিরোধী দলসমূহ এবং সাধারণ জনগণের উচিত- তরুণ নেতৃত্ব ও বালেন্দ্রর প্রতি আস্থা রাখা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, এখন সময় এসেছে কার্যকর এবং নৈতিক নেতৃত্বের।

দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট বলছে, এবারের আন্দোলন শুধু সরকারের বিরুদ্ধে নয়- এটি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সংগ্রাম। এই সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হবে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও নৈতিকতা। আর সেই নতুন নেপালের চালকের আসনে গোটা জাতি বালেন্দ্র শাহকে দেখতে চায়।

জেন-জি’র বিজয়, নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি’র পদত্যাগ

তীব্র জনরোষের পর অবশেষে পদত্যাগ করলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। কিছুক্ষণ আগে তিনি টেলিভিশনে দেয়া বিবৃতিতে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এ খবরে আনন্দে ভাসছে নেপাল। পদত্যাগ করার পর ওলি’র ভবিষ্যত কি হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে মিডিয়ায় একটি কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। তাহলো তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন। আশ্রয় নিতে পারেন অন্য কোনো দেশে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার মতো পরিণতি ভোগ করতে পারেন। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ওলি বলেছেন, তিনি সাংবিধানিক সমাধানের পথ তৈরি করে দেয়ার জন্য পদত্যাগ করছেন।

এর আগে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে দেয় বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপির বাসভবনে। এ অবস্থায় দেশটির আভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল অচল হয়ে গেছে। আংশিক বন্ধ হয়ে গেছে কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মঙ্গলবার সানেপায় শাসকদল নেপালি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় জেন-জি আন্দোলনকারীরা। আগুনে পুড়ছে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ব্যক্তিগত বাসভবন। দাউ দাউ জ্বলছে আরও মন্ত্রী, এমপিদের বাসভবন। বিক্ষোভকারীদের এখন একটাই দাবি পদত্যাগ করতে হবে প্রধানমন্ত্রী ওলি’কে। কিন্তু এক বিবৃতিতে তিনি বিক্ষোভকারীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষোভের আগুন কিছুতেই প্রশমিত হয়নি। কারফিউ ভঙ্গ করে বিভিন্ন শহরে নেমে পড়েছে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ওলি’র পদত্যাগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে প্রভাবশালী পত্রিকা কাঠমান্ডু পোস্ট।

অনলাইন এনডিটিভি বলছে, এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষি বিষয়ক মন্ত্রী সহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন বা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে।  আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে মন্ত্রী আরজু রানা দেউবা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখাকের বাড়িতে। জ্বলছে যোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রী পৃথ্বি শুভ গুরুংয়ের বাসভবন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ডের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর বাইরে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ।

কাঠমান্ডু পোস্ট আরও বলছে, সোমবার নিরাপত্তা বাহিনীর দমন অভিযানে ১৯ তরুণ বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার পর থেকেই এ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে বিক্ষোভ দমন করে। এ ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্রথমে দুর্নীতি ও কুশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ সড়ক বিক্ষোভ হিসেবে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে তা সহিংস রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ও বড় বড় রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। কাঠমান্ডু উপত্যকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। অশান্তি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় কারফিউ জারি করেছে কর্তৃপক্ষ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.