পশ্চিমা নেতারা কি মুখ রক্ষা করতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন
ইসরায়েল সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আগ্রাসী অবস্থান আরও জোরদার করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এক মুখপাত্র বলেন, এই স্বীকৃতি ‘হাস্যকর’। এটি ‘সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করবে’ বলে উল্লেখ করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
১৫ সেপ্টেম্বর অধিকৃত পশ্চিম তীরে এক অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে দম্ভভরে বলেন, ‘ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র হবে না।’
কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের এই স্বীকৃতি সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক খবরের প্রধান শিরোনাম। বিশ্লেষকেরা আল-জাজিরাকে বলেছেন, অবমাননা, হত্যাকাণ্ড ও শত–সহস্র ফিলিস্তিনিকে ঘরছাড়া করার বিরুদ্ধে এটি একটি ক্ষুদ্র ও প্রতীকী পদক্ষেপ। তবে এর বাইরেও পদক্ষেপটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক রয়েছে।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবু রাস আল-জাজিরাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা কেবল একটি সমঝোতাপূর্ণ চুক্তির পরই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তার আগেই প্রচলিত ধারা ভেঙেই দেশগুলো স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। এ কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ইসরায়েল আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আমি মনে করি, এটি তাৎপর্যপূর্ণ।’
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে চার দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার দিনও গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় অন্তত ৫৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ জনই গাজা নগরীর।
লোকদেখানো স্বীকৃতি
ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে চরম দুর্দশায় জীবন কাটছে ফিলিস্তিনিদের। এই স্বীকৃতি কি তাঁদের দুর্দশার অবসান ঘটাবে? কোনো বাস্তবসম্মত পরিবর্তন কি আসবে?—সংশয়ে আছেন বিশ্লেষকেরা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৬৫ হাজার ২৮৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। যুদ্ধে আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৫ জন। তবে অনেক বিশ্লেষকের বিশ্বাস, হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
অন্যদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীদের সহিংস হামলায় এ পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সরকার হুমকি দিয়েছে, তারা পুরো অঞ্চলটি নিজেদের দেশের সঙ্গে যুক্ত করে নেবে।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে চার দেশের স্বীকৃতি গাজায় যুদ্ধ থামাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এ যুদ্ধকে ইসরায়েলি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো জাতিগত হত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
স্বাধীন গবেষক ক্রিস ওসিক বলেন, ‘এই স্বীকৃতির পাশাপাশি যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র অবরোধ এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনে নো ফ্লাই জোন বাস্তবায়নের মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আশাবাদী হতে পারছি না।’
দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক মোহাম্মদ এলমাসরি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এটি মূলত লোকদেখানো স্বীকৃতি। আমি মনে করি, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। যাতে বলতে পারে যে তারা কিছু একটা করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
তবে এরপরও এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ফিলিস্তিন সরকার স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি ও রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করতে পারবে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ঘোষণা করেছে, তারা হুসাম জোমলটকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগদান
বিশ্বের বড় একটি অংশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি আরও কিছু স্বীকৃতি যোগ হয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র, হাতেগোনা কিছু ইউরোপীয় ও বাল্টিক দেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশ এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি পেলেও জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে পারেনি ফিলিস্তিন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবু রাস বলেন, মার্কিন সহায়তা ছাড়া এসব স্বীকৃতি জাতিসংঘের নতুন কোনো সুযোগ-সুবিধা এনে দেবে না। নতুন করে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যও হতে পারবে না ফিলিস্তিন।
আল রাস বলেন, ‘ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য নয়, বরং পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র।’ পূর্ণ সদস্য হতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ পেতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভোট পেতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতার কারণে এটি প্রায় অসম্ভব।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে চাপ জোরালো হচ্ছে। গতিশীল হচ্ছে ইসরায়েলকে বর্জনের প্রচার-প্রচারণাও। ফলে ইউরোভিশন ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো থেকে ইসরায়েলকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সম্প্রতি কিছু ইসরায়েলি পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং দেশটির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়েও আলোচনা করেছে।
মুখ বাঁচাতে স্বীকৃতি
বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে বলেছেন, কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করলেও কিছু পশ্চিমা দেশ মূলত গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় এ পদক্ষেপ নিয়েছে। শর্তসাপেক্ষে কিছু দেশের সমর্থনও এ পদক্ষেপের পেছনে জোরালো ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষকেরা আরও বলেছেন, একদিকে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর চাপ, অন্যদিকে জাতিগত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবি—দেশের ভেতরে এমন নানামুখী চাপের কারণেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা।
আল রাস বলেন, বর্তমানে উদার-বামপন্থী সরকারগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে এমনটি ঘটেছে। আসলে কিছুই বদলায়নি। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণকে খুশি রাখতে এটি ছিল অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তাঁরা আসলে নিজেদের মুখ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েল কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে তিনি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
গতকাল রোববার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াও শর্তসাপেক্ষে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পূরণে আরও অগ্রগতি করলে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং দূতাবাস চালুর মতো পদক্ষেপও নেওয়া হবে।
![]() |
| গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও ইসরায়েলকে বয়কটের দাবিতে স্পেনে একটি বিক্ষোভের চিত্র। ফাইল ছবি: রয়টার্স |

No comments