হারেৎজের প্রতিবেদন: গাজায় ক্ষুধা অস্বীকার হলোকাস্ট অস্বীকারের মতো ঘৃণ্য by গিডিয়ন লেভি

ইহুদি হলোকাস্ট অস্বীকারের মতো ঘৃণ্য ঘটনা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। যারা এটি অস্বীকার করে, তারা বলে এটি আদৌ ঘটেনি, আর যদি ঘটেও থাকে, মৃতের সংখ্যা খুবই সামান্য ছিল, কিংবা গ্যাস চেম্বার বলে কিছু ছিল না। তারা পরিমাপ ও তথাকথিত ডাটার মাধ্যমে এসব দাবি তুলে ধরেছে। তাদের দাবি, হলোকাস্ট ছিল একটি ষড়যন্ত্র- ক্ষতিপূরণ আদায় ও সহানুভূতি অর্জনের হাতিয়ার। এমন অস্বীকারকে অনেক দেশেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং অস্বীকারকারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সাধারণভাবে, একে ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবেই দেখে। বৃটিশ ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্ভিং অস্ট্রিয়ায় এই কারণে কারাবরণ করেছেন এবং সমাজচ্যুত হয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরের ঘটনাকে ঘিরেও যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের প্রতি ইসরাইলে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে- তাদেরকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে দাগানো হয়েছে। যখন শিল্পী রজার ওয়াটার্স বলেন যে, ধর্ষণের কোনো প্রমাণ নেই এবং শিশুদের চুল্লিতে পোড়ানোর গল্প ইসরাইলের তৈরি মিথ্যা- তখন তাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়। আরও অনেকে যারা ইসরাইলি বর্ণনার অতিরঞ্জন তুলে ধরেন, তারাও একইভাবে আক্রান্ত হন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অস্বীকারের একটি ঘৃণ্য স্রোত বইছে ইসরাইলেই, এবং এটি এখন দেশটির অনেক স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় সব গণমাধ্যমই এতে অংশ নিচ্ছে।

আমরা প্রথমে চেষ্টা করেছি উপেক্ষা করতে, লুকাতে, মুখ ফিরিয়ে নিতে, হামাসকে দোষারোপ করতে, বলতে চেয়েছি যুদ্ধের সময় এমন হয়, এমনকি দাবি করেছি গাজায় কোনো নির্দোষ মানুষ নেই। কিন্তু একসময় ইসরাইলের অপরাধ এতটা সীমা অতিক্রম করল, যে তা আর অস্বীকার করা সম্ভব হলো না। যখন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাণঘাতী অনাহার শুরু হলো, তখন একমাত্র অবশিষ্ট পথ ছিল অস্বীকার করা এবং এই অস্বীকার ঠিক ততটাই ঘৃণ্য, যতটা হলোকাস্ট অস্বীকার। এখন ইসরাইলে যে অস্বীকার চলছে, তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গণহত্যার উদ্দেশ্য অস্বীকার এবং গাজার জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা অস্বীকার। এই অস্বীকার সেখানে স্বাভাবিক, রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কেউ এই অনাহার ঘটানোর জন্য অভিযুক্ত বা শাস্তি পাবে না। এটি এখন মূলধারার ভাবনায় পরিণত হয়েছে। গাজার অনাহারকে বলা হচ্ছে ‘ইহুদিবিদ্বেষী ষড়যন্ত্র’। যদি ক্ষুধা থেকেই থাকে- তাহলে দায় হামাসের।

এটাই হয় যখন সব অজুহাত, কল্পকাহিনি ও প্রচারণা শেষ হয়ে যায়। তখন মানুষ এমন বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বলে- ‘ক্ষুধা নেই’- যখন চিত্রগুলো চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। কী অধিকার তাদের এই কথা বলার? ইসরাইলি অস্বীকারের রয়েছে অন্তত ৫০টি রূপ। প্রত্যেকটিই সমানভাবে ঘৃণ্য- কেউ চোখ সরিয়ে রাখে, কেউ চোখ ঘুরিয়ে নেয়, কেউ নিজেকেই মিথ্যা বলে। সবগুলোর লক্ষ্য এক- দায় এড়িয়ে যাওয়া, নিজেদের ‘ভিকটিম’ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং নিজেদের প্রশংসা গাওয়া। এই দলে শুধু সাধারণ মানুষ নয়- ইসরাইলের চার গবেষক মিলে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন- ‘তলোয়ার যুদ্ধের তথাকথিত গণহত্যা’। এই প্রবন্ধের অসারতা তুলে ধরেছেন হলোকাস্ট ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল ব্ল্যাটম্যান এবং হারেৎজের সাংবাদিক নির হাসোন। আরও রয়েছেন, দৈনিক ইসরাইল হায়োম বিলি করা এক নারী, যিনি আমাকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন- ‘ক্ষুধার ছবিগুলো ইয়েমেনের, বা এআই দিয়ে তৈরি।’ এছাড়া টেলিভিশনের একজন পণ্ডিত সাংবাদিক মরিয়া আসরাফ- যিনি অপমানজনক রকমের ঊর্ধ্বতন ভঙ্গিতে সাংবাদিক ইমানুয়েল এলবাজ-ফেল্পসকে চুপ করিয়ে দেন। এমনকি প্রায় সব টিভি নিউজ সম্পাদকই গাজায় কী ঘটছে, তা গোপন করছেন।

এই অস্বীকার ইসরায়েলের দীর্ঘ ইতিহাস- প্রথম নাকবা (১৯৪৮) থেকেই, যে নাকি আদৌ ঘটেনি, এসব কেবলই ইসরাইল-বিদ্বেষীদের কল্পনা। এই অস্বীকার অব্যাহত ছিল দখল ও বর্ণবাদী শাসনের সব বছরজুড়ে। বিশ্বে এমন কোনো সমাজ নেই, যারা নিজেদের এতখানি অস্বীকারের মধ্যে রেখে দেয়। এর পেছনে ইসরাইলের তথাকথিত ‘স্বাধীন গণমাধ্যম’-এর বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলো যা দেখিয়েছে, তা নৈতিক অধঃপতনের নতুন রেকর্ড। ‘গাজায় অনাহার নেই’-এই দাবির পেছনে যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে- ‘সীমান্তে তো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে’, ‘ক্ষুধায় মারা যাওয়া শিশুদের মা-বাবা মোটা’, ‘হামাসের একটি ভিডিও আছে যেখানে তারা গুহায় কলা খাচ্ছে’- যদিও ছবিটি ছয় মাস আগের এবং এটি ছড়াচ্ছে আইডিএফ মুখপাত্র, যিনি দেশের সবচেয়ে বড় মিথ্যা প্রচারক। এই অস্বীকার কেবল দায় এড়ানোর চেয়ে বেশি ঘৃণ্য- এটি ভিকটিমদের প্রতি অবমাননা। যে মা তার ক্ষুধার্ত, মৃতপ্রায় শিশুকে কোলে নিয়ে কাঁদছে- তাকে বলা হচ্ছে, ‘এটি ইচ্ছাকৃত অনাহার নয়’- এটি তার যন্ত্রণাকে বিদ্রুপ করারই নামান্তর।

আমি বহু বছর ধরে বিশ্বাস করতাম- যদি সব প্রমাণ ইসরাইলিদের সামনে হাজিরও করা হয়, তারা তাও অস্বীকার করবে। এখন সেই প্রমাণ এখানে- ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি বিশ্বের সংবাদপত্র ও টিভি স্ক্রিনে ছেয়ে গেছে- তবুও ইসরাইলিরা তা অস্বীকার করছে। কী আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা বলছে- ‘এসব ছবি ভুয়া, ক্ষুধায় কেউ মরেনি, কলা আছে, দিনে ৮০টা ট্রাক ঢুকছে।’ এটিই করতেন ফরাসি অধ্যাপক রবার্ট ফোরিসন। তিনি বলতেন, গ্যাস চেম্বারের পরিমাপ অনুযায়ী হলোকাস্ট ঘটেনি। গাজা আজ সেই একই নিষ্ঠুর অস্বীকারের শিকার- নিখাদ মানবিকতা ও ন্যায়ের বিপরীত এক ভয়ঙ্কর রূপ।

(অনলাইন হারেৎজ থেকে অনুবাদ) 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.