গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন: তীব্র অপুষ্টিতে ১২ হাজার শিশু

ফিলিস্তিনের গাজায় খাদ্যসংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে খাবার না পেয়ে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, গাজায় এখন পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১২ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। আর চলতি বছরের শুরু থেকে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে ৯৯ ফিলিস্তিনির। তাঁদের মধ্যে ৩৫ জনই শিশু।

শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি নিয়ে সতর্ক করে জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় পাঁচ বছরের নিচের ২ লাখ ৯০ হাজার শিশুর মধ্যে মাত্র ৮ হাজার ৭০০ শিশুকে প্রয়োজনীয় খাবার ও পুষ্টি উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ডব্লিউএইচওর সদর দপ্তরে মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, জুলাই মাসে গাজায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১২ হাজার শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে, যারা তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, এটিই এক মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক শিশুর অনাহারে থাকার ঘটনা।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল—ইউনিসেফের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের চেয়ে জুলাই মাসে গাজায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি শিশুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জুনে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিল ৬ হাজার ৩৪৪ জন। আর জুলাইয়ে ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৮৭৭ জন। তাদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছিল।

গাজার অপুষ্টির শিকার শিশুদের জন্য গড়ে তোলা চারটি চিকিৎসাকেন্দ্রে সহায়তা করছে ডব্লিউএইচও। তবে সেখানে শিশুদের জন্য ফর্মুলা দুধ ও পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহ খুবই কম বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সব পথ দিয়ে গাজায় আরও বড় পরিসরে ত্রাণ প্রবেশ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গেব্রেয়াসুস।

দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন এক ভিডিও বার্তায় বলেন, গাজায় বর্তমানে যে পরিমাণে পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহ করা হচ্ছে, তা অনাহার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকানোর জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয়। গাজায় যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, সেই তালিকায় বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন।

গাজায় যখন অনাহার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে, না খেতে পেয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে এবং সীমিত পরিসরে ত্রাণ প্রবেশ করছে, তখন উপত্যকাটিতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ)। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে গাজার বাসিন্দাদের খাদ্য গ্রহণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। উপত্যকাটির ৮১ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা খুবই কম পরিমাণে খাবার খেয়ে বেঁচে আছেন। গত এপ্রিলে এই হার ছিল অর্ধেকেরও কম, ৩৩ শতাংশ। গাজার মোট বাসিন্দা প্রায় ২২ লাখ।

চলতি বছরে অনাহারে ৯৯ মৃত্যু

গাজায় অনাহারে মৃত্যুর একটি চিত্রও তুলে ধরেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত গাজায় অনাহারে ৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৬৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ৩৫ জন শিশু। এই শিশুদের মধ্যে ২৯ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, গাজার বাসিন্দারা মৌলিক সেবাগুলো সীমিত পরিমাণে পাচ্ছেন। ইসরায়েলের হামলার মুখে তাঁরা বারবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে উপত্যকাটিতে অনাহার ছড়িয়ে পড়ছে। না খেতে পেয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ২২ মাস ধরে চলমান সংঘাতে অনাহারে ১৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯৬ জনই শিশু। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টির কারণে গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে চারজন প্রাণ হারিয়েছেন।

এ ছাড়া ত্রাণ সংগ্রহ করতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদেরও হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল শুক্রবার মধ্য গাজার নেতজারিম করিডোরের কাছে ত্রাণ নিতে গিয়ে আরও দুজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত মে মাস থেকে নিহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসা হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। সেদিন থেকে থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫২ হাজারের বেশি মানুষ।

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো এলাকা। সেখান থেকে মাথায় করে একটি স্ট্রলার নিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি এক শিশু। এই স্ট্রলারে করে নবজাতক বা ছোট শিশুদের বহন করা হয়। গতকাল গাজা নগরীতে
ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো এলাকা। সেখান থেকে মাথায় করে একটি স্ট্রলার নিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি এক শিশু। এই স্ট্রলারে করে নবজাতক বা ছোট শিশুদের বহন করা হয়। গত ৮ আগস্ট ২০২৫ গাজা নগরীতে ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.