হারেৎজের মতামত কলাম: ইসরাইলকে কি ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু?
নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাতকে ‘বর্বরতা বনাম সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তবে এই বিভাজন ভেঙে পড়ছে। ইসরাইল কি সত্যিকার অর্থেই ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নেতানিয়াহু কি ফিলিস্তিনিদের ‘ফিন’ জাতির মতো শান্ত ও সভ্য করতে চান? নাকি তাদের ‘অ-ফিন’ হিসেবে থাকাটাই ইসরাইলের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করেন, যাতে কোনো সমাধান না করার অজুহাত পাওয়া যায়?
নেতানিয়াহু মনে করেন সময় ইসরাইলের পক্ষে আছে। কিন্তু এই ধারণা একটি বিপজ্জনক ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। গাজায় ইসরাইলের প্রতিটি কঠোর আঘাত ফিলিস্তিনিদের জয়ী করছে। কারণ, দুর্বলদের আত্মত্যাগই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। যত বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হচ্ছে, গাজায় ক্ষুধা ও দুর্ভোগ বাড়ছে, বিশ্বজুড়ে ইসরাইল ততই দুর্বল ও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ইসরাইলের সময় ফুরিয়ে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার সমালোচনা করেছেন কলামিস্ট ক্যারোলিনা ল্যান্ডসম্যান। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম ইসরাইলের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ডেমোক্রেট নয়, রিপাবলিকানদের মধ্যেও এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
নেতানিয়াহুর এই নীতি ইসরাইলি সমাজের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। ইহুদি আধিপত্য বাড়ছে এবং ফিলিস্তিনিদের পরিচয় কেবল ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই নীতি কেবল সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করবে, কিন্তু কোনো সমাধান দেবে না। ফরমালডিহাইড যেমন কেবল মৃতদেহ সংরক্ষণ করে, নেতানিয়াহুর কৌশলও তেমনি কেবল ‘মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি’ করছে। ল্যান্ডসম্যান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলের এই আত্মঘাতী যাত্রার কাউন্টডাউন বা ক্ষণগণনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
গাজায় ইসরাইলের ব্যাপক বোমা হামলা, নিহত আরও ৬১
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর সামরিক অভিযান তীব্র হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুরু হওয়া হামলায় অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন বলে মেডিকেল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। নিহতদের মধ্যে ১৯ জন ত্রাণপ্রার্থীও রয়েছেন। গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক বোমা হামলার খবর পাওয়া গেছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা।
এতে বলা হয়, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলের এই অভিযানের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি যুদ্ধের একটি নতুন এবং বিপজ্জনক ধাপের ইঙ্গিত। তিনি বলেন, গাজা সিটিতে সামরিক অভিযানের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। কারণ এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি আবারও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হবেন।
এদিকে, গাজা সিটির শুজাইয়া, জেইতুন এবং সাবরা এলাকাগুলোতে ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলার কারণে বাসিন্দারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উপকূলের দিকে পালাচ্ছেন। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মতে, জেইতুন এলাকার দক্ষিণাংশে ইসরাইলি স্থল অভিযানে ১৫০০-এর বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। ইসরাইলি কর্মকর্তারা গাজা সিটিকে হামাসের শেষ দুর্গ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা গাজায় জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, রাফাহতে ত্রাণ নিতে যাওয়া ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক গুম করে ফেলা হচ্ছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খাদ্যের জন্য ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে জোরপূর্বক গুম করা শুধু মর্মান্তিক নয়, এটি এক ধরনের নির্যাতন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার অনাহারে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে দুইজন শিশু। ফলে এই যুদ্ধে অনাহারে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৭ জনে, যার মধ্যে ১২১ জনই শিশু।
আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জৌম দেইর আল-বালাহ থেকে জানান, সেখানকার পরিস্থিতি হৃদয়বিদারক। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে, কিন্তু প্রায়শই খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। ইসরাইলের সামরিক হামলায় এখন পর্যন্ত ৬২,৯০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
গাজার জেইতুনের সকল ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল
গাজা শহরের জেইতুন এলকার সকল ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল। সেখানে আর কোনো ভবন অক্ষত নেই। এ মাসের শুরুতে গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরাইল। এতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এদিকে রাতভর হামলায় কমপক্ষে ১১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক নারী ও শিশু আছে। তারা বুরেজি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ছিলেন। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল জাজিরা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্য আইপিসি’র ঘোষণাকে সমর্থন করেছে। এতে বলা হয়েছে, গাজার দুর্ভিক্ষ মানুষ সৃষ্ট সংকট। বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে একটি নীতিগত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
শিক্ষাবিদ লোরেনজো কামেল বলেছেন, ওই বৈঠকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান হতে পারে না। তবে তিনি বলেন, অস্ত্র, নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদির শর্তাবলীর বিষয়ে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। কামেল আরও বলেন, লেবাননের একটি বৃহৎ অংশ গাজার মতো পরিণতি ভোগ করতে যাচ্ছে। এর আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প হিজবুল্লাহকে ধ্বংসের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই কথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) তরফে বলা হয়েছে, ২২ মাসের যুদ্ধে তাদের একজন কর্মীকে গাজা থেকে ১৯ বার বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এক্সে এক পোস্ট দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, চলমান বোমা হামলায় অধিকাংশ মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। আরও বলা হয়েছে, মানুষ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন।

No comments