জেলেনস্কির নামই মুখে নেন না পুতিন, তিনি কি তাঁর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণঃ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবজ্ঞা এতটাই গভীর যে তিনি কালেভদ্রেও ‘জেলেনস্কি’ নামটি মুখে আনেন না। ক্রেমলিনের মতে, তিনি অবৈধ নেতা। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন তাঁকে ‘ভাঁড়’ সম্বোধন করে থাকে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতার ভিত্তির ধারণাই হলো এই—যুদ্ধ শেষ করতে হলে পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসতেই হবে। গত সোমবার পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর ট্রাম্প বলেন, তিনি এ ধরনের বৈঠকের ‘ব্যবস্থা শুরু করেছেন’।

এর পর থেকে মস্কোয় কূটনৈতিক আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর জন্য ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগ ঘিরে মঙ্গলবার বড় প্রশ্ন ছিল, এই যুদ্ধের প্রধান শত্রুরা (পুতিন-ট্রাম্প) কি সত্যিই দ্রুত একান্তে বসতে যাচ্ছেন?

পুতিনের জন্য এ ধরনের শীর্ষ বৈঠক একটি শান্তিচুক্তি পাকা করার সুযোগ, যাকে ক্রেমলিন বিজয় হিসেবে প্রচার করতে পারবে। তবে তা তখনই সম্ভব হবে, যদি ইউক্রেনের ভূমি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে পুতিনের দাবির বিষয়ে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে রাজি করাতে পারেন। কিন্তু এতে রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। কারণ, ক্রেমলিন এত দিন ধরে ইঙ্গিত দিয়ে এসেছে, জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসা রুশ প্রেসিডেন্টের মর্যাদার জন্য হানিকর।

‘এটি একধরনের আপস’ বলে মন্তব্য করে মঙ্গলবার এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার জ্যেষ্ঠ আইনপ্রণেতা কনস্তান্তিন জাতুলিন বলেন, পুতিন-জেলেনস্কি সম্ভাব্য বৈঠকটিকে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে একধরনের ছাড় হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে রাশিয়া জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক–সম্পর্কিত নিজেদের উদ্বেগ এক পাশে সরিয়ে রাখবে।’

জাতুলিন বলেন, রাশিয়ার কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, পুতিনের কোনো পরিস্থিতিতেই জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করা উচিত নয়। কারণ, ‘রাশিয়া সর্বত্র জেলেনস্কির অবৈধ নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলছে’। কিন্তু জাতুলিনের ব্যক্তিগত মত হলো, জেলেনস্কির সঙ্গে একটি শীর্ষ সম্মেলন বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কারণ, ‘পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে কোনো সম্ভাবনাকেই উপেক্ষা করা ঠিক নয়’।

ক্রেমলিন পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠকের সম্ভাবনার দরজা সব সময় খোলা রেখেছে। চলতি সপ্তাহেও এক বার্তায় তারা বলেছে, পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠক সম্ভব। কিন্তু তা শিগগিরই হবে কি না, তা নিয়ে তারা কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ক্রেমলিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলেনস্কি রাশিয়ার মূল দাবিগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত, এমনটি যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে পুতিনের বৈঠক কল্পনা করাটাই কঠিন।

সেন্ট পিটার্সবার্গের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ গ্রিগরি গোলোসভ এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শিগগিরই বা অদূর ভবিষ্যতে আমি এমন কোনো বৈঠকের সম্ভাবনা দেখি না।’ তাঁর ধারণা, পুতিন কেবল তখনই জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করতে রাজি হবেন, যদি এটা স্পষ্ট হয় যে ইউক্রেনের আত্মসমর্পণ বা জেলেনস্কিকে পরাজয় স্বীকার করাতে এমন একটি বৈঠকের প্রয়োজন আছে।

অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক হলে রাশিয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর যুক্তি হিসেবে বলেছেন, জেলেনস্কি এমন একটি ‘শাসনব্যবস্থা’ চালাচ্ছেন, যা রুশভাষীদের ওপর গণহত্যা (জেনোসাইড) চালাচ্ছে। পুতিনের এই বয়ান মিথ্যা। কারণ, জেলেনস্কি নিজেই রুশ ভাষায় কথা বলে বড় হয়েছেন।

২০১৯ সালে জেলেনস্কি বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় মস্কোতে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, তিনি কিয়েভে এমন একটি সরকার গঠন করবেন, যা হবে রাশিয়ার প্রতি আরও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ।

কিন্তু পুতিন সেই সময় থেকে জেলেনস্কির বিষয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিদ্রূপপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছেন। উদাহরণ হিসেবে ২০২৩ সালের একটি ঘটনার কথা বলা যায়। তখন জেলেনস্কির ইহুদি পরিচয়কে আক্রমণ করে পুতিন বলেছিলেন, তাঁর ইহুদি বন্ধুরা তাঁকে বলেছেন, ‘জেলেনস্কি ইহুদি নন, তিনি ইহুদি নামের কলঙ্ক।’

পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠক করলে তাঁরা সমমর্যাদার বলে প্রমাণিত হবেন। এই কারণে জেলেনস্কি ও পুতিন বৈঠক করতে যাচ্ছেন বলে ট্রাম্প বারবার যে দাবি করছেন, তা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে।

মঙ্গলবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নেতাদের বৈঠক সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছেন, ‘তাঁরা হয়তো আমার ধারণার চেয়ে কিছুটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করছেন।’ কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে সুসম্পর্কের কোনো প্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই কারণে আমি প্রথমে ত্রিপক্ষীয় নয়, বরং তাঁদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব করেছি।’

ট্রাম্পের ভাষায়, ‘অন্যথায় আমি দুজনকে আলাদা করে বসানোর ব্যবস্থা করতাম না। আমি তিনজনের বৈঠকের ব্যবস্থা করতাম।’

সোমবার ফোনালাপের পর ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে একটি একান্ত বৈঠকের আয়োজন করা হবে। জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে তিনি পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। বৈঠক শেষে জেলেনস্কি সাংবাদিকদের বলেন, আগের মতো তিনি এখনো পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে প্রস্তুত।

সোমবার পুতিন-ট্রাম্পের ফোনালাপ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাশিয়ার বিদেশনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ। এতে তিনি পুতিন-জেলেনস্কির শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে কিছু বলেননি।

উশাকভের ভাষ্যমতে, ট্রাম্প ও পুতিন ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরাসরি আলোচনায় আরও উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যুক্ত করার সম্ভাবনাগুলো খুঁজে দেখার’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও একই রকমের অস্পষ্ট মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্রেমলিন নীতিগতভাবে জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিরুদ্ধে নয়। তবে ‘উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যেকোনো বৈঠক খুব সতর্কভাবে আয়োজন করা উচিত’।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পুতিনের কূটনৈতিক তৎপরতায় এক অস্বাভাবিক গুরুত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, তিনি ট্রাম্পের উদ্যোগকে গুরুত্বসহকারে নিচ্ছেন। ক্রেমলিন চলতি সপ্তাহে জানিয়েছে, পুতিন সৌদি আরব, কিরগিজস্তান, ব্রাজিল, ভারত, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ও বেলারুশের নেতাদের ফোন করেছেন। তাঁদের তিনি ইউক্রেন–সংক্রান্ত সর্বশেষ আলোচনার বিষয়ে জানিয়েছেন।

মস্কোর হায়ার স্কুল অব ইকোনমিকসের নিরাপত্তানীতি–বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি ট্রেনিন বলেছেন, পুতিন ‘সম্ভবত মনে করছেন, এটাই প্রকৃত কূটনীতির সময়। (আলাস্কায়) ট্রাম্পের সঙ্গে সমাধানের যে রূপরেখা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তা সম্ভবত তাঁর জন্য সুবিধাজনক।’

দিমিত্রি ট্রেনিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যা ছাড় দিতে প্রস্তুত, তা নিয়ে যদি ক্রেমলিন সন্তুষ্ট হতে পারে, তাহলে তখনই হয়তো জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি হবেন পুতিন। এই নিরাপত্তা–বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, পুতিন তাঁর বিস্তৃত দাবি থেকে এখনো সরেননি। যেখানে ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিজেদের করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে দেশটির সামরিক ক্ষমতা সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে ট্রাম্প চাপ সৃষ্টি করছেন। মনে হচ্ছে, তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে সংলাপ করতে পুতিনকে প্ররোচিত করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পকে ফোনালাপে পুতিন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, জেলেনস্কি সরকারকে সরিয়ে কিয়েভে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সাময়িক প্রশাসন বসালেই কেবল যুদ্ধ শেষ হতে পারে। পুতিনের এই মনোভাব ট্রাম্পকে বিরক্ত করেছিল।

সেন্ট পিটার্সবার্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষক গ্রিগরি গোলোসভের মতে, ‘ফেব্রুয়ারির ট্রাম্প-পুতিনের আলাপের পর থেকে রাশিয়ার বক্তব্য কিছুটা কোমল হয়েছে। তবে জেলেনস্কির বিরুদ্ধে তাদের এখনো প্রচুর সমালোচনা আছে। কিন্তু তারা এখন এ কথা বলার সাহস করছে না—তিনি (জেলেনস্কি) এতটাই অবৈধ প্রেসিডেন্ট যে তাঁর সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন আছে।’

রাশিয়ার আইনপ্রণেতা জাতুলিন বলেন, ক্রেমলিন যে জেলেনস্কির সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের কথা বিবেচনা করছে, তা রাশিয়ার সেই প্রচেষ্টার অংশ, যাতে ট্রাম্পকে দেখানো যায়, তারা ‘চুক্তি করার জন্য প্রস্তুত’। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া এই পথ বেছে নিয়েছে এবং ট্রাম্পের ওপর সেটার প্রভাব পড়েছে।’

মঙ্গলবার রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু যা আলোচনা হয়েছে, তাতেই ক্রেমলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ চ্যানেলগুলো জেলেনস্কিকে উপহাস করতে ছাড়েনি। রাজনৈতিক টক শো ‘সিক্সটি মিনিট’–এর উপস্থাপিকা অলগা স্কাবেয়োভা বলেন, সোমবার হোয়াইট হাউসের বৈঠকে জেলেনস্কি ‘স্কুল ছেলের মতো’ আচরণ করেছেন। ‘বোকার’ মতো হেসেছেন এবং ‘বরাবরের মতো খটমট ইংরেজিতে’ কথা বলেছেন।

বিশ্লেষকদের অনুমান, পুতিন যদি মনে করেন, এমন বৈঠক করা লাভজনক, তাহলে এখন যেসব অপপ্রচার চলছে, তা মুহূর্তের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মস্কোর রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিখাইল বিনোগ্রাদভ বলেন, ক্রেমলিন মনে করছে, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করলে পুতিনকে তেমন কোনো চড়া রাজনৈতিক মূল্য গুনতে হবে না।

বিশ্লেষক মিখাইল বিনোগ্রাদভ বলেন, ‘প্রচার যন্ত্র ধরে নিচ্ছে যে (পুতিন-জেলেনস্কির) মধ্যকার আলোচনার যেকোনো ফলাফল গ্রহণ করতে সমাজ প্রস্তুত। সমাজ এখানে বড় কোনো বাধা নয়। রাশিয়ার সমাজ এরই মধ্যে অনেক কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।’

 রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (বাঁয়ে) ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (বাঁয়ে) ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ফাইল ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.