গাজার শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপুষ্টি তিনগুণ বেড়েছে

গাজার অবরুদ্ধ এলাকায় ক্ষুধার সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) জানিয়েছে, গাজা সিটিতে তাদের ক্লিনিকে ৫ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপুষ্টির হার গত দুই সপ্তাহে তিনগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন ক্ষুধার কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। কারণ ইসরাইল মাত্র সামান্য পরিমাণে ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন গার্ডিয়ান। এমএসএফ জানায়, গাজা সিটিতে তাদের ক্লিনিকে মে মাস থেকে অপুষ্টির চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। গত সপ্তাহে তারা যে শিশু ও গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী নারীদের পরীক্ষা করেছে, তাদের এক-চতুর্থাংশই অপুষ্টিতে ভুগছিল। সংগঠনটির ১,০০০-এরও বেশি কর্মী গাজায় মাতৃসেবা থেকে শুরু করে জরুরি সার্জারি পর্যন্ত বিভিন্ন চিকিৎসা দিচ্ছে। এমএসএফ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করার অভিযোগ তুলেছে। শতাধিক ত্রাণ সংস্থা বলছে, ইসরাইল গাজায় অধিকাংশ ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। সংস্থাটি বলেছে, ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ইসরাইলের ব্যবহার নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও এখন বাঁচার জন্য লড়ছে।

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কমপক্ষে ১২২ জন ক্ষুধায় মারা গেছে। ২৪ ঘণ্টায় আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দিনের পর দিন কিছু খেতে পারছে না। আর ৯০,০০০ নারী ও শিশুর জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। গাজার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নাজি আল-কুরাশালি বলেন, প্রকৃত পরিস্থিতি সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক ভয়াবহ। তিনি অনুমান করেন, প্রতিদিন তিনি যে শত শত গর্ভবতী নারীকে দেখেন, তাদের অর্ধেক অপুষ্টিতে ভুগছেন।

তিনি বলেন, এত ভয়াবহ অবস্থা আমি আমার চিকিৎসা জীবনে কল্পনাও করিনি। গর্ভপাতের ঘটনা বেড়ে গেছে, আর জন্ম নেওয়া শিশুরা অধিকাংশই ওজন কম, অকালে জন্ম নিচ্ছে বা জন্মগত বিকৃতিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি আরও জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করতে হচ্ছে, এমনকি নোংরা গ্লাভস দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। একজন অসহায় চিকিৎসক হিসেবে এটা সহ্য করা যায় না। অনেক সময় হাসপাতালে দৌড়ে বের হয়ে যাই কারণ রোগীদের ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ করতে পারি না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গণক্ষুধার ঘটনায় সবচেয়ে আগে মারা যায় শিশুরা ও গর্ভবতী নারীরা। তবে ইসরাইল ক্ষুধা সংকটের দায় অস্বীকার করেছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছে এবং দায় দিয়েছে জাতিসংঘকে, যারা ইসরাইলি বিধিনিষেধের কারণে গাজায় ৪০০টি বিতরণকেন্দ্র ব্যবহার করতে পারছে না।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা শুধু মানবিক সংকট নয়, নৈতিক সংকটও, যা বিশ্বের বিবেককে চ্যালেঞ্জ করছে। শুক্রবার বৃটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, গাজার মানবিক বিপর্যয় এখনই শেষ হওয়া উচিত এবং ইসরাইলকে ত্রাণে বিধিনিষেধ শিথিল করার আহ্বান জানান।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেন, সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের ওপরও একই চাপ বাড়ছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ম্যাক্রনের ঘোষণাকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে, তারা জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলতে দেবে, যদিও এটি ব্যয়বহুল এবং লরি দিয়ে আনা ত্রাণের তুলনায় কম সরবরাহ বহন করতে পারে। হামাস একে ‘রাজনৈতিক নাটক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। গাজায় গর্ভবতী ৩১ বছর বয়সী আমাল মাসরি বলেন, খাবার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ সময় আমি ভীষণ দুর্বল বোধ করি, রক্তচাপ খুব কম থাকে, মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে, যেন মৃত্যু আসন্ন। তার স্বামী মার্কিন-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) বিতরণ কেন্দ্র থেকে খাবার পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং অনেক সময় আহত হয়ে ফিরছেন। ১,০০০-রও বেশি মানুষ এসব বিতরণকেন্দ্রের কাছে খাবার সংগ্রহের চেষ্টায় গুলি খেয়ে মারা গেছে, যদিও জিএইচএফ এ দায় অস্বীকার করেছে।

এদিকে, যুদ্ধবিরতি আলোচনাও ভেস্তে গেছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কাতার থেকে নিজেদের আলোচক ফিরিয়ে নিয়েছে। ট্রাম্প হামাসকে দোষারোপ করে বলেছেন, ওরা সমঝোতা চায় না, আর ওদের নেতাদের শিকার করা হবে। হামাস অভিযোগ করেছে, সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার জন্য ইসরাইল দায়ী। হামাস কর্মকর্তা বাসেম নাঈম বলেন, আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছি তা পরিস্থিতির জটিলতা বিবেচনায় যথেষ্ট কার্যকর, যদি শত্রুপক্ষ সমঝোতায় ইচ্ছুক হতো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.