একদিনে আরও শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা: দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বড় হুমকির মুখে ইসরাইলের অর্থনীতি
সূত্র: জিও নিউজ
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বড় হুমকির মুখে ইসরাইলের অর্থনীতি
নতুন এক মাত্রায় পৌঁছেছে ইরান-ইসরাইল সংঘাত। এখন যুদ্ধের প্রধান ক্ষেত্র শুধু অস্ত্রে নয়, অর্থনীতিও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। সামরিক হামলার পাশাপাশি ইরান এবার সরাসরি ইসরাইলের আর্থিক অবকাঠামোতে আঘাত হেনেছে। জুনে ইসরাইলের বন্ড করপোরেশনের প্রধান দানি নাভেহের বাসভবনে আঘাত হেনেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। বলে রাখা ভালো ওই করপোরেশনটির মাধ্যমে গত কয়েক মাসে প্রবাসী ইহুদি ও বিভিন্ন সরকারি উৎস থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছে দানি। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিনিয়োগকারীদের আস্থায়ও বড় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এছাড়া ইসরাইলের প্রধান বন্দর হাইফায় হামলা ও মায়ার্সক- এর জাহাজ চলাচল স্থগিত করে দেওয়া ইসরাইলের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা বলে বিবেচিত হচ্ছে। বন্দরটি বন্ধ হওয়ায় আমদানি ঘাটতি ও জ্বালানি সংকটের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়েছে। এছাড়া বীমা খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশটি কার্যত বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়তে পারে।
মিডলইস্ট আইয়ের অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক আহমেদ আলকারারৌত তার এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ইরানের এই আক্রমণ কৌশলগত ও সাশ্রয়ী। মাত্র ২-৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তারা ইসরাইলের ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের যুদ্ধ খরচ আকাশচুম্বী। কমছে মুদ্রার মান, আর বেড়েছে বন্ডের সুদহার। বিনিয়োগও নিম্নমুখী। যা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। এখন জার্মানি, ফ্রান্স ও উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে অর্থ সাহায্য চাইছে ইসরাইল। যা নজিরবিহীন ঘটনা। এমন যুদ্ধব্যায় দেশটির অর্থনীতিতে কতটা গভীর চাপ তৈরি করেছে তারই বড় প্রমাণ।
এ সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কৌশল নিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। একদিকে ইরানের চীনমুখী রেলযোগাযোগে হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে সিরিয়া-লেবাননে উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে ইরানের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। সব মিলিয়ে, যুদ্ধবিরতি কেবল সময়ক্ষেপণ বলে মনে করেন আহমেদ। তিনি বলেন, ইরান কৌশলে এগিয়ে গেছে, আর অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছে ইসরাইল। এখন এই শূন্যতা ব্যবহার করে অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।
কোনদিকে নেতানিয়াহু যুদ্ধ নাকি শান্তি?
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ বছর তৃতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে পা রাখতে চলেছেন। তবে এবারের সফর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গাজা যুদ্ধ ২০ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে ইসরাইলকে কঠিন এক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি করা হচ্ছে। তা হলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নাকি কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সপ্তাহেই আমরা একটি যুদ্ধবিরতি দেখতে চাই। কিন্তু নেতানিয়াহু কি যুদ্ধবিরতির অবস্থায় আছেন? এ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে সিএনএন বলছে, নেতানিয়াহুর এই সফর এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ইসরাইল ক্রসরোডে। তার এবারের সফরের মূল আলোচ্য বিষয় গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিদের মুক্তি। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ইসরাইলিরা গাজায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজা ভূখণ্ডের শতকরা ৬০ ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে এখন ইসরাইলি সেনারা। পক্ষান্তরে গাজার ২০ লাখের বেশি মানুষের প্রায় সবাই বাস্তুচ্যুত। তারা উপকূল এলাকার দিকে ছুটে গেছেন। সেখানেও রক্ষা নেই। সেখানেও তাদের ওপর বোমা ফেলছে ইসরাইল। এ অবস্থায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, হামাসের অনেক শীর্ষ নেতা নির্মূল হলেও তাদের সামরিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। তাই শক্তির ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নাকি যুদ্ধবিরতির দিকে এগোবে তা নিয়ে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা এখন দ্বিধায়। সেনাবাহিনী কূটনৈতিক পথে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও ডানপন্থী জোটের অংশীদাররা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দাবিতে অনড়। আবার বন্দি মুক্তিই এখন মূল অগ্রাধিকার বলে মত দিয়েছেন কল্যাণ মন্ত্রী ইয়াকভ মারগি। তিনি বলেছেন, আমরা ৬০০ দিনের বেশি দেরি করে ফেলেছি। মঙ্গলবার কাতার সরকার ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি নতুন প্রস্তাব জমা দেয় হামাস ও ইসরাইল উভয়ের কাছে। এ প্রস্তাবে হামাসের শর্তাবলী আংশিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবটির নেপথ্যে কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। তবে সমস্যা রয়ে গেছে- হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে এসেছে এবং তারা গাজায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়, যা ইসরাইল মানতে নারাজ।
যুদ্ধবিরতির আলোচনার সাথে সাথে একটি নতুন দিকও সামনে এসেছে- গাজার মানবিক সহায়তা কেন্দ্রে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি ইসরাইলের পক্ষ থেকে আলোচনা করা হয়েছে, যা প্রস্তাব পেশের আগ মুহূর্তেই পুনরায় আলোচনায় এসেছে। সাবেক মেজর জেনারেল ইসরাইল জিভ বলছেন, এখন নেতানিয়াহুর সামনে দুইটি পথ খোলা আছে। তা হলো একদিকে যুদ্ধ বন্ধ করে হামাসের বিপক্ষে অর্জনকে কূটনৈতিক চুক্তিতে রূপান্তর করে সিরিয়া ও লেবাননের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ নেওয়া। অন্যটি হলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যা বাস্তবিক অর্থে গাজা পূর্ণাঙ্গ দখলের পথে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের উপর নেতানিয়াহুর সরকার টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে ডানপন্থীদের প্রতিক্রিয়ার উপর।

No comments