হামাস নিয়ে ভাবার সময় এসেছে by হাসান ফেরদৌস

দুই বছর হতে চলল, গাজায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। আরব দেশগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় অত্যাধুনিক ‘ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ বানানোর কথা বলে সুবিধা না করতে পেরে অন্য বিষয়ে মন দিয়েছেন। দু-চারটি ইউরোপীয় দেশ মুখে নরম-গরম কথা বললেও গণহত্যা বন্ধে ইসরায়েলের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগ নেই। জাতিসংঘ মহাসচিব অনেক কথা বলছেন বটে, কিন্তু সে কথা বাস্তবায়নের কোনো শক্তি তাঁর নেই। এই অবস্থায় গাজাবাসীর মরা ভিন্ন আর কী পথ আছে?

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তার একটি ছবি মিলেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের পাঠানো এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। তাতে ইসলাম আবু তাইয়েমা নামের একজন মা ও তাঁর ৯ বছরের মেয়ের কথা বলা হয়েছে। আবু তাইয়েমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। গাজায় যুদ্ধ শুরুর আগে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করতেন। এখন চাকরি নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, ঘরে দানাপানি নেই। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তাই তিনি গাজার রাস্তায় রাস্তায় ডাস্টবিন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করছেন। সারা দিন ঘুরে হয়তো আধখাওয়া রুটি জুটল। ‘আজকের জন্য এটাই আমাদের আহার,’ আবু তাইয়েমা এপিকে বলেছেন। ‘কেউ বুঝতেও পারবে না কী দুর্যোগের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি।’

গাজা অভিযানের শুরুতে এক ইসরায়েলি মন্ত্রী হাতের তিন আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের সামনে তিনটি পথ খোলা। পালানো, গুলি খেয়ে মরা অথবা সাগরে ডুবে মরা। তাঁদের পরিকল্পনামাফিক ইসরায়েল তার সে কাজ গুছিয়ে এনেছে। কাজটা যে এত সহজ হবে দেশটির সরকার তা হয়তো ভাবেনি। তাদের ভয় ছিল, হামাস মরণপণ লড়াই করে তাদের মস্ত ক্ষতি করবে। আরব দেশগুলোও ক্রোধে জ্বলে উঠবে, বিশ্বসভায় আপ্তবাক্য শোনানো ছাড়াও তাকে থামানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছুই হয়নি, ফলে চালাও গুলি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত পৌনে দুই বছরে প্রায় ৫৪ হাজার ৬৭৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৩০ জন। ইসরায়েল বলেছে, হামাসের শেষ সেনা শেষ না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলের হিসাবমতে, গত দেড় বছরে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ১৭ হাজার হামাস সেনা। হামাস নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা কেউ প্রশিক্ষিত নন। তাদের ট্যাংক বা ভারী কোনো সাঁজোয়া বহর নেই। সামরিক বিমানের তো প্রশ্নই উঠছে না।

ইসরায়েল হামাসকে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হিসেবে, পূর্ণ সেনাবাহিনী হিসেবে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়েছে। আমরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা ভেবে প্রশংসা করেছি। এমন কথাও বলেছি, হামাসের ভয়ে ইসরায়েল কাঁপছে।

এই দুই বাহিনীর তুলনা একদমই অবাস্তব। ইসরায়েলের রয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ নিয়মিত সৈন্য। আছে আরও সাড়ে চার লাখ রিজার্ভ। প্রযুক্তিগতভাবে তারা বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর সামরিক বাহিনী। বছরে সেনা খাতে দেশটির ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া মাথার ওপর ছাতা হয়ে ‘আঙ্কল স্যাম’তো রয়েছেনই।

মাথা মোটা এমন কারও পক্ষেও বোঝা সম্ভব যে ইসরায়েলকে সামরিকভাবে পরাস্ত করা একা হামাসের পক্ষে সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এককাট্টা হয়ে সে চেষ্টা করলে একটা মরণকামড় দেওয়া হয়তো সম্ভব, যেমন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। এখন আরব দেশগুলো ব্যস্ত ইসরায়েলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে। আর এই কাজে দূতিয়ালির দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

এসব জানা সত্ত্বেও হামাসের যোদ্ধারা মরণপণ লড়ে যাচ্ছেন। তাঁরা মরছেন, সঙ্গে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ গাজাবাসী, সংখ্যায় যাঁদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যায় বেশি। যেহেতু হামাস যোদ্ধা ও সাধারণ গাজাবাসীর মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই—এই শহরে সবাই যোদ্ধা—সে কারণে ইসরায়েল একজন হামাস যোদ্ধাকে টার্গেট করে দুই ডজন মানুষ মারছে।
স্পষ্টতই লড়াই করে ইসরায়েলকে হারাব, হামাসের এই রণকৌশল কাজে দিচ্ছে না। তাদের ভিন্ন রণকৌশলের কথা ভাবতে হবে। যেমন ইয়াসির আরাফাত ভেবেছিলেন। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যাক।

১৯৮২ সালে, বৈরুতে অব্যাহত ইসরায়েলি আক্রমণ এড়াতে ফিলিস্তিন মুক্তিসংগ্রামের নেতা আরাফাত তাঁর সঙ্গী ১৪ হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাসহ লেবানন ছেড়ে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে সরে আসেন। আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ চালিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারতেন, কিন্তু নতুন যুদ্ধের কৌশল নির্মাণ করতেই তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। এর ১০ বছর পর ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় অসলো চুক্তি, যার ভিত্তিতে সীমিত আকারে হলেও পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিন প্রশাসন গঠিত হয়। এ কথা ঠিক, সে চুক্তির ২০ বছর পরেও ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেনি; বরং প্রতিদিন ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অধিগ্রহণে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার পরিমাণ ক্রমেই কমে এসেছে। এ জন্য অবশ্যই পূর্ণ স্বাধীনতা প্রশ্নে ইসরায়েলের অনীহা প্রধান কারণ, তবে ২০০৬ সালের পর গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে চলে আসাও একটা কারণ। সে বছর পশ্চিম তীর ও গাজায় যে নির্বাচন হয়, তাতে হামাস বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে জয় লাভ করে। এ নিয়ে বিবাদ বাধলে গাজার নিয়ন্ত্রণভার একরকম জোর করেই গ্রহণ করে হামাস। তখন থেকেই পশ্চিম তীর ও গাজায় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন—ফাতাহ ও হামাস, তাদের অভিন্ন শত্রু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দুই হাত এক করে লড়াইয়ের বদলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। ইসরায়েল তাতে ইন্ধন জোগানোয় এ বিভক্তি আরও বেড়েছে।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে স্পষ্ট, লড়াই করে তাঁকে পরাস্ত করা হামাসের পক্ষে সম্ভব নয়। শেষ হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করার কথা বলে ইসরায়েল শুধু যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তা–ই নয়, গাজাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এক সপ্তাহ আগেও ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলছেন, গাজার শেষ বাসিন্দাটি সরে না যাওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। পাশাপাশি গাজার ২২ লাখ মানুষকে মিসর, জর্ডান ও আফ্রিকার একাধিক দেশে স্থানান্তরের জোর চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টার পেছনে চলতি মার্কিন প্রশাসনেরও সমর্থন রয়েছে।

গাজা থেকে যদি হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সদলবল মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোথায় সরে যেতে সম্মত হয়, অনুমান করি, গাজার চূড়ান্ত ধ্বংস হয়তো ঠেকানো সম্ভব। হামাস ইসরায়েলের ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ এই যুক্তি দেখিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। যদি হামাসই না থাকে, তাহলে অব্যাহত বোমাবাজির পক্ষে যুক্তি দেখাবেন কী করে?

এ কথা ঠিক, ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে গাজায় গণহত্যার তীব্র নিন্দা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ইসরায়েলের ভেতরেই কেউ কেউ বলেছেন, হামাস নয়, এই আগ্রাসনের কারণে বিশ্বজুড়ে যে নিন্দা রব উঠেছে, সেটাই ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য আসল সংকট। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হারেৎজ পত্রিকায় এক উপসম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছেন, ‘গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা যুদ্ধাপরাধ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’ পরে সিএনএনকে তিনি বলেছেন, ‘হামাস এখন আর আমাদের জন্য হুমকি নয়। এখন যা করা হচ্ছে, তা নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড।’ তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, ‘আগ্রাসন অব্যাহত রেখে ইসরায়েলের কোনো সামরিক লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না, বরং রাজনৈতিকভাবে আমরা বিশ্বব্যাপী ধিক্কারের মুখোমুখি হচ্ছি।’

নেতানিয়াহু সে কথা মানতে রাজি নন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এই যুদ্ধ তাঁর প্রয়োজন। যুদ্ধ বন্ধের পরদিনই তাঁর অতি দক্ষিণপন্থী কোয়ালিশন ভেঙে পড়বে, সে কথা তিনি জানেন। ফলে হামাসের দিকে আঙুল তুলে তিনি নিজেকে নৈতিকভাবে অধিক বলবান বলে প্রমাণ করতে চান। সম্প্রতি ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সীমিত আকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। সে কথার জবাবে নেতানিয়াহু বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার কথা বলে এই তিন দেশ সন্ত্রাসীদের পক্ষে কাজ করছে, মানবতার পক্ষে নয়।

হামাস যদি আর কোনো ‘ফ্যাক্টর’ না হয়, এই দলের যোদ্ধাদের হত্যার প্রয়োজন না থাকে, তাহলে নেতানিয়াহুর পক্ষে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের খোঁড়া যুক্তি দেখানো সহজ হবে না। হামাসের প্রস্থানের অন্য আরেক সম্ভাব্য ফল হবে, পশ্চিম তীর ও গাজা এই দুই ভূখণ্ডকে আবার মিলিত করা। রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে এত দিন যে কোনো অগ্রগতি হয়নি, তার অন্যতম কারণই হলো গাজাকে ঘিরে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বে বিভক্তি।

দেশের বাইরে বসে হামাসের সাহসিকতার যত প্রশংসাই আমরা করি না, গাজায় এ মুহূর্তে তার পক্ষে জনসমর্থন ১০ শতাংশেরও কম। ইসরায়েলে হামলার পর নেওয়া জনমত জরিপ অনুসারে, গাজার মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ হামাসকে এই এলাকার শাসনভার তুলে দিতে সম্মত। এই জনমত সত্যি হলে হামাসের হাতে গাজার নিরপরাধ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে, এ কথা বলা একদম অযৌক্তিক হবে না।

হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব গাজা থেকে সরিয়ে নিতে হলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোকে। এত দিন তারাই অর্থ দিয়ে তাকে জিইয়ে রেখেছে। বস্তুত, হামাসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় সবাই এখন কাতার অথবা উপসাগরের কোনো না কোনো দেশে অবস্থান করছেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রস্থানের সময় হামাসকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে সম্মত হয়, তাহলে ব্যাপারটা ত্বরান্বিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৮২ সালে আরাফাতকে যুক্তরাষ্ট্র সে নিশ্চয়তা দিয়েছিল।

ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল—গাজার সব জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা থেকে হামাসকে উৎখাতের পর এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কাকে দেওয়া হবে, এখন বিশ্ব মোড়লেরা ব্যস্ত সেই চিন্তায়। রাফাহ এলাকায়
ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল—গাজার সব জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা থেকে হামাসকে উৎখাতের পর এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কাকে দেওয়া হবে, এখন বিশ্ব মোড়লেরা ব্যস্ত সেই চিন্তায়। রাফাহ এলাকায়। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.