যুক্তরাষ্ট্রই কীভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির পথ তৈরি করে দিয়েছিল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেন, তখন তিনি এক জটিল সমস্যায় পড়েন। এই সমস্যার শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে। তখন যুক্তরাষ্ট্রই ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে প্রথম সহায়তা দিয়েছিল।

তেহরানের উত্তরে একটি ছোট পারমাণবিক চুল্লি রয়েছে। এটি শান্তিপূর্ণ গবেষণার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। গত ১২ দিনের সংঘাতে ইসরায়েল এই স্থাপনায় কোনো হামলা চালায়নি।

এই পারমাণবিক চুল্লির গুরুত্ব প্রতীকী। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এটি ইরানে পাঠিয়েছিল। এটি ‘অ্যাটম ফর পিস’ কর্মসূচির অংশ ছিল।

এই কর্মসূচি চালু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার। উদ্দেশ্য ছিল মিত্রদেশগুলোকে পারমাণবিক প্রযুক্তি দেওয়া। এতে তাদের অর্থনীতি উন্নত হবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হবে।

এই চুল্লি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য ব্যবহার হয় না। কারণ, এটি খুব দুর্বল জ্বালানিতে চলে। বোমা তৈরির মতো শক্তি এতে নেই।

বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, পাকিস্তানসহ আরও কিছু দেশ ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির জন্য দায়ী। তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের পথে সহায়তা দিয়েছে।

তেহরানের এই চুল্লি একসময়ের স্মৃতিচিহ্ন। তখন ইরান ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমাপন্থী রাজতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইরানকে প্রযুক্তি শিখিয়েছিল।

পরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। শুরুতে এটি উন্নয়নের প্রতীক ছিল। পরে এটি হয়ে ওঠে সম্ভাব্য সামরিক শক্তির উৎস।

পশ্চিমারা ইরানের এই কর্মসূচিকে ঘিরে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তখনকার বিশ্ব আজকের চেয়ে আলাদা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতেই পারেনি, তার দেওয়া প্রযুক্তি একদিন তার বিপদ ডেকে আনবে।

যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় থাকা রবার্ট আইনহোর্ন বলেন, ‘ইরানের শুরুটা আমরাই করেছিলাম।’

আইনহোর্ন বলেন, ‘তখন প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়া নিয়ে আমরা বেশি ভাবতাম না। আমরা অনেক দেশকে এ প্রযুক্তি দিয়েছিলাম।’

১৯৫৩ সালে জাতিসংঘে আইজেনহাওয়ার এক ভাষণে বলেন, পারমাণবিক ভয় থেকে বিশ্বকে মুক্ত করতে হবে। এই অস্ত্র সেনাদের হাত থেকে সরানো যথেষ্ট নয়। এটা এমন মানুষের হাতে দিতে হবে, যাঁরা এটিকে শান্তির কাজে লাগাবেন।

এই কর্মসূচি কেবল মানবিক উদ্দেশ্যে ছিল না। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজের অস্ত্র মজুত আড়াল করছিল।

অনেক বিজ্ঞানী এ কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। ওপেনহাইমার তাঁদের একজন। তিনি বোমা তৈরি করেছিলেন। পরে অনুশোচনায় যুক্ত হন এই শান্তির প্রকল্পে।

যুক্তরাষ্ট্র এ কর্মসূচি কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছিল। ইসরায়েল, পাকিস্তান, ইরান—সবাইকে প্রশিক্ষণ ও যন্ত্র দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এগুলো চিকিৎসা বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে।

১৯৬৭ সালে ইরান একটি চুল্লি পায়। তখন ইরানের শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

১৯৫৩ সালে শাহ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা—সিআইএর সহায়তায় ক্ষমতায় আসেন। অনেক ইরানির কাছে এটি অপমানজনক ঘটনা।

শাহ দেশকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেন। নারীদের বোরকা নিষিদ্ধ করেন। তিনি পশ্চিমা শিক্ষা চালু করেন। শিল্প ও অবকাঠামোয় বড় বিনিয়োগ করেন।

অ্যাটম ফর পিসের আওতায় শাহ বড় বাজেট রাখেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জ্বালানি স্বাধীনতা ও জাতীয় গর্ব। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইরানি তরুণদের এমআইটিতে পাঠায়। তাঁরা পারমাণবিক প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৭০-এর দশকে ইরান ইউরোপের সঙ্গে চুক্তি করে। শাহ ফ্রান্স সফরে যান। পাঁচটি চুল্লি কেনার চুক্তি করেন। তখন শাহ ছিলেন পারমাণবিক শান্তির মুখ। মার্কিন বিজ্ঞাপনেও তাঁর ছবি ব্যবহার হয়। তাতে বলা হয়, ‘যদি শাহ চুল্লির নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ করতেন, তাহলে এখনই এগুলো বানাতেন না।’

ইরান পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবু যুক্তরাষ্ট্র শাহর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ফ্রান্সের চুক্তিতে নিরাপত্তা শর্ত নেই। পরে শাহ বলেন, ইরান নিজেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে।

বাইরের হস্তক্ষেপকে শাহ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলেন। আজকের ইরান সরকারও এমন কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়। শাহ তখন জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে ঝুঁকে পড়েন। দক্ষিণ আফ্রিকা ইউরেনিয়াম সরবরাহে রাজি হয়।

১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট কার্টার চুল্লির চুক্তির শর্ত পরিবর্তন করেন। যাতে ইরান অস্ত্রযোগ্য জ্বালানি তৈরি না করতে পারে। এই পারমাণবিক চুল্লি আর পাঠানো হয়নি। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন।

তখন মনে হয়েছিল, ইরানের পারমাণবিক যাত্রা থেমে যাবে। খোমেনি সরকার এতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু ইরাকের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে ইরান বিপর্যস্ত হয়। তখন তারা পারমাণবিক শক্তির গুরুত্ব টের পায়। তারা পাকিস্তানের দিকে তাকায়। বিজ্ঞানী এ কিউ খান সেন্ট্রিফিউজ সরবরাহ করেন। এগুলো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে।

গ্যারি সামোর দাবি করেন, এই সেন্ট্রিফিউজই ইরানের পারমাণবিক সংকট তৈরি করেছে। এই প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র দেয়নি। পাকিস্তান দিয়েছিল। আর তা ছিল ইউরোপীয় নকশা থেকে নেওয়া।

তবে ইরানের যে পরমাণুকাঠামো, তার ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রই করে দিয়েছিল। এরপর ইরান গোপনে কার্যক্রম চালায়। তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে থাকে। ২০০২ সালে এসব তথ্য প্রকাশ পায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ চায়, ইরান সব বন্ধ করুক।

কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ, এমনকি হামলা করেও সমাধান হয়নি। ট্রাম্প বলেন, হামলায় স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু অনেক অংশ অক্ষত রয়ে গেছে।

সামোর বলেন, এই অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেখার আছে। এখন সৌদি আরবের সঙ্গেও চুক্তির আলোচনা চলছে। এই উদ্যোগ বাইডেন সরকারের আমলে শুরু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত এমন দেশকে প্রযুক্তি দেয় না, যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

সামোর বলেন, ‘আমরা এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াকেও পরমাণু প্রযুক্তি দিইনি।’

সামোরের ভাষ্য, সৌদি আরব বলে, তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম চায়। এই প্রযুক্তি দিয়ে বোমাও বানানো যায়। তাই এমন দেশকে দেওয়া বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হবে।

ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। ফাইল ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.