আল-জাজিরার রিপোর্ট: নন্দনগরের হাসানের কাহিনী

নন্দনগর, উত্তরাখণ্ড।  প্রতিদিন সকাল ৮টায় আহমেদ হাসান নন্দকিনী নদীর তীরে তার ড্রাই ক্লিনিং দোকানের বাদামি শাটারটি টেনে দেন। নদীটি উত্তর ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের প্রত্যন্ত হিমালয়ের পাদদেশের শহর নন্দনগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। আহমেদ তার দোকানের গোলাপী দেয়ালে প্লাস্টিকের কভারে সুন্দরভাবে ড্রাই-ক্লিন করা কাপড় ঝুলিয়ে রাখেন। তারপর ৪৯ বছর বয়সী আহমেদ গ্রাহকদের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুপুরের খাবারের সময় তার কাছে ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক আসতেন। তাদের শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক রেখে যেতেন। কেউ কেউ রাজনীতি এবং রসিকতা নিয়ে আলোচনা করার সময় হাসি-দুঃখ ভাগাভাগি করে আহমেদের সঙ্গে এক কাপ চা পান করতেন। বেশির ভাগ গ্রাহক ছিলেন হিন্দু, কয়েকজন মুসলিম।

প্রজন্মের পর  প্রজন্ম ধরে ১৫টি মুসলিম পরিবার নন্দনগরকে নিজেদের বাড়ি বলে মনে করতেন। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। তার পরিবার হিন্দুদের উৎসবের সময় আমন্ত্রণ পেতো। আবার তারাও ঈদে প্রতিবেশীদের আতিথেয়তা করতেন। হিন্দুদের শেষকৃত্যের জন্য কাঠ সংগ্রহ করেতেন আহমেদ। হিন্দু বন্ধুদের মৃতদেহ নিজে কাঁধে তুলেছেন। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক মেয়ের যৌন হয়রানির অভিযোগের পর মুসলিমবিরোধী সহিংসতায় সবকিছু বদলে যায়। এর মূলে ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তন। যা হাসান কোভিড-১৯ এর পর থেকে লক্ষ্য করেন। ঘৃণাপূর্ণ স্ল্লোগান এবং মিছিলের ফলে মুসলমানদের উপর শারীরিক আক্রমণ শুরু হয়। তাদের দোকানপাট ধ্বংস করা হয়। জীবনের ভয়ে শহরের মুসলিম সম্প্রদায় রাতের আড়ালে পালিয়ে যায়। কেবল হাসান ফিরে এসেছিলেন তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই ছেলেকে নিয়ে। দৃঢ়ভাবে বলেন, তিনি যে জায়গাটিকে নিজের বাড়ি বলে জানেন, সেখানেই কাজ করতে পারবেন। কিন্তু পরিবারটি আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে কথা বলে না। হাসান আর  প্রতিদিন সন্ধ্যায় আগের মতো নদীর ধারে হাঁটতে যান না। তার সন্তানদের এবং স্ত্রীকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। আরও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে চিন্তিত তিনি। হাসান বলেন, আমি শুধু আমার দোকানে যাই এবং বাড়ি ফিরে আসি। এটাই এখন আমাদের জীবন। এই শহরে সারা জীবন কাটানোর পর আমার মনে হচ্ছে আমি একটা ভূত। আমি সম্পূর্ণ অদৃশ্য। কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলছে না।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে নন্দনগর ১০ ঘণ্টার পথ। ভারত-চীন সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই শহরটি নন্দাকিনী নদীর উপ-নদীগুলোর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এবং এর জনসংখ্যা প্রায় ২০০০। নন্দাকিনী নদী গঙ্গা নদীর ছয়টি উপ-নদীর মধ্যে একটি এবং হিন্দুদের কাছে এটি পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ১৯৭৫ সালে হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে এখানে চলে আসেন। তাদের পরিবার এ শহরে বসতি স্থাপন করে। এক বছর পর হাসানের জন্ম হয়। তিনি স্মরণ করেন ২০২১ সাল পর্যন্ত জীবন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। করোনাভাইরাস মহামারির সময় হিন্দু উগ্র-ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কারণে ভারতজুড়ে মুসলমানদের অপমান করা হয়। অভিযোগ করা হয় যে, মুসলিমরা ধর্মীয় রীতিনীতি এবং বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। উগ্র-ডানপন্থিরা এটিকে ‘করোনা জিহাদ’ বলে অভিহিত করে। হঠাৎ হাসানের মনে হয় তার হিন্দু বন্ধুরা দূরে সরে যাচ্ছেন। হাসান বলেন, কোভিড-১৯ এর আগে ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে অনেক লোক আসতো। আর দীপাবলিতে বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক আমন্ত্রণ পেতাম। কিন্তু কোভিডের পর এটা বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু ২০২৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বরের ঘটনাগুলো ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ।

এক সপ্তাহ আগে ২২শে আগস্ট সেলুন খোলার সময় মোহাম্মদ আরিফ নামে এক মুসলিম  খৌরকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন এক হিন্দু ছাত্রী। এর ফলে আরিফ শিগগিরই শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। ১লা সেপ্টেম্বর শহরের দোকানদার সমিতি ছাত্রীর উপর কথিত হয়রানির নিন্দা জানাতে এবং পুলিশি ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শহরের অন্য মুসলিমদের সঙ্গে  প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন হাসানও। তিনি বলেন, আমরা গিয়েছিলাম কারণ, অন্যথায় হিন্দুরা অভিযোগ করবে যে মুসলমানদের সংঘটিত অপরাধকে সমর্থন করি আমরা। তবে, লোকজন অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিমবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করে, সহিংসতার হুমকি দেয়। আমরা যখন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে হাঁটছিলাম, তখন মুসলিমবিরোধী স্লোগান উঠছিল। নন্দ নগরের পুলিশ স্টেশনে সমাবেশটি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের একটি দল ৩০ বছর বয়সী এক মুসলিম ব্যক্তি হারুণ আনসারীকে ধরে মারধর শুরু করে। হাসান বলেন, তাকে মারধরের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে অভিযোগ করেন যে, শহরের মুসলিমরা অভিযুক্ত আরিফকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

ঘটনার পর নাজিবাবাদে চলে যান আনসারী। সেখান থেকে এক ফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার মাথায় একাধিক আঘাত লেগেছে। আমার শুধু মনে আছে জনতা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর আর কিছুই আমার চোখে পড়েনি। আনসারীকে মারধর করার পর, হাসান সহ অন্য মুসলিমরা সমাবেশ থেকে পালিয়ে যান এবং নিজেদের ঘরে আটকে রাখেন। শত শত লোকের একটি দল এসে তাদের বাড়িগুলোতে পাথর ছুড়তে শুরু করে।
হাসান বলেন, মুসলিম পরিবারগুলো সাহায্যের জন্য পুলিশকে ফোন করতে থাকে। কিন্তু কেউ আসেনি। তিনি তার হিন্দু বন্ধুদেরও ফোন করেন। কিন্তু তারা হাসানের ফোনও ধরছিল না।

সন্ধ্যার দিকে ওইসব লোক চলে যায়। ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম পরিবারগুলো ঘরের মধ্যেই অবরুদ্ধ ছিল। সেই রাতে ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেল, হাসান চুপচাপ তার বাড়ির সামনের দোকানে ফিরে যান। দেখতে পান তার দোকানের শাটার ভাঙা এবং মচকে গেছে। ড্রাই-ক্লিন করা কাপড় রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একটি শক্ত কাঠের টেবিলের ড্রয়ারে তিনি ৪০০,০০০ রুপির সঞ্চয়  
তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তা ভেঙে গেছে- টাকা চুরি হয়ে গেছে। তিনি সন্তানদের বিয়ের জন্য সেই টাকা জমা করেছিলেন। তার দোকান, দ্য হাসান ড্রাইক্লিনার্সের নাম বোর্ডের টুকরোগুলো নন্দাকিনী নদীর তীরে ধ্বংসাবশেষের মতো ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। হাসান বলেন, আমি সেই দিনটি কখনই ভুলবো না।

২রা সেপ্টেম্বর হিন্দু উগ্র ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলো আরও বড় একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা অন্য শহরের লোকদেরও নন্দনগরে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানায়। হারুণ বলেন, সেখানে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। আর পুলিশ ছিল মাত্র ৬০-৭০ জন। আমাদের অভিযোগ সত্ত্বেও, অতিরিক্ত কোনো পুলিশ ডাকা হয়নি। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যের জন্য পরিচিত হিন্দু উগ্র ডানপন্থি নেতা দর্শন ভারতীও সেদিন নন্দনগর পরিদর্শন করেন। হাসান বলেন, তার বক্তৃতার পর জনতা তাণ্ডব চালিয়ে আমাদের সম্পত্তি ভাঙচুর করে। তারা একটি অস্থায়ী মসজিদ ধ্বংস করে এবং একজন মুসলিম বাসিন্দার গাড়ি নদীতে ফেলে দেয়। নন্দনগরে তার সফর এবং পরবর্তী সহিংসতা সম্পর্কে আল-জাজিরার  প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ভারতী।

হাসান বলেন, জনতা যখন পাথর ছুড়ছিল, তখন শহরের মুসলিম পরিবারগুলো আমার বাড়ির উপরের তলায় লুকিয়েছিল। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও আমার কাঁপুনি ধরে। তার বাড়িতে লোহার গ্রিল এবং একটি গেট রয়েছে। এটি একটি বহুতল ভবন, যা মুসলিম পরিবারগুলোর জন্য আশ্রয় নেওয়াকে আরও নিরাপদ করে তুলেছিল।

যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত আরিফকে ১লা সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার পর সেদিনই উত্তর প্রদেশ থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরিফকে এক সপ্তাহের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয় এবং তারপর জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। তবে, পুলিশ মুসলিম পরিবারগুলোকে জানিয়ে দেয় যে, তারা আর তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবে না। অন্ধকারে অফিসাররা তাদেরকে পুলিশের গাড়িতে করে কাছের একটি শহরে নামিয়ে দেন।  বেশির ভাগ মুসলিম পরিবারের জন্য, এটি ছিল নন্দনগরে জীবনের শেষ সময়। কিন্তু হাসানের জন্য নয়। তিনি বলেন, এটা আমার বাড়ি। আমার জন্ম, লালন-পালন, আমার জীবনের সবকিছু, আমার পরিচয় সহ সব কিছু উত্তরাখণ্ডে। আমার পুরো পরিবার উত্তরাখণ্ডে থাকে। আমি এখন কোথায় যাব?

হাসান ও তার পরিবার ২৬৬ কিলোমিটার (১৬৫ মাইল) দূরে অবস্থিত রাজ্যের রাজধানী দেরাদুনে চলে যান। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর হাসান এবং নন্দনগরের বাসিন্দা ৪৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আইয়ুম ২৬শে সেপ্টেম্বর উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে সুরক্ষার আবেদন করেন। হাইকোর্ট চামোলি জেলার সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ (এসএসপি)কে নির্দেশ দিয়েছেন, নন্দনগরে আইনশৃঙ্খলা কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে এবং কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে।
হাসান বলেন, হাইকোর্ট আমাদের সুরক্ষা দেওয়ার পর ভেবেছিলাম আমি এখন নন্দনগরে যেতে পারি। কিন্তু ভয়ে অন্য কোনো মুসলিম পরিবার আমার সঙ্গে যেতে  প্রস্তুত ছিল না। হাসানের ভাই নন্দনগরে একটি সেলুন চালাতেন। হাসান বলেন, কিন্তু তার বাড়িওয়ালা তাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে- যদি তিনি তার দোকান খালি না করেন, তাহলে তিনি তার জিনিসপত্র ফেলে দেবেন। চামোলির একটি বৃহত্তর শহর গোপেশ্বরে বসবাসকারী অন্য আত্মীয়রা তার পরিবারকে কোনো সহায়তা দেননি। হাসান বলেন, অনেক চিন্তা-ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম যে- আমাকে ফিরে যেতে হবে। কারণ আমার বাড়ি এবং দোকানসহ সবকিছুই নন্দনগরে।

হাসান আরও বলেন, তার স্ত্রী তার চেয়েও বেশি সাহসী। সে  প্রথমে আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে নন্দনগরে যায়। আমি পরে শহরে এসেছি। ভয় থাকা সত্ত্বেও, সে আমাকে বলেছিল যে- আমরা যদি ফিরে না যাই, তাহলে আমরা আমাদের জীবিকা হারাবো।
নিশ্চিতভাবেই পরিবারটি এখনও একটি দ্বিধার মুখোমুখি। হাসান তাদের মেয়ের স্কুল শেষ করার পর তার পরিবারকে দেরাদুনে স্থানান্তরিত করার কথা ভাবছেন। তবে তার স্ত্রী বিশ্বাস করেন, তারা যদি অন্য কোথাও চলে যান, তাহলে তাদের বাড়ি ও দোকান স্থানীয়রা দখল করবে। অবশেষে হাসান ১৬ই অক্টোবর নন্দনগরে পৌঁছান। দেখতে পান, হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি তার দোকানের সামনে একটি ড্রাই-ক্লিনিং দোকান খুলেছেন। হাসান বলেন, তিনি নিজের দোকান মেরামত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো হিন্দু কর্মী সাহায্য করতে রাজি হননি। এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে যে, কোনো কর্মী আমাদের দোকান মেরামত করতেও প্রস্তুত নয়। শ্রমিকরা আমাকে বলেছে, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো তাদেরকে মুসলমানদের সাহায্য না করার নির্দেশ দিয়েছে।
হাসান নিজেই মেরামত করে অবশেষে তার দোকানটি খুলতে সক্ষম হন। কিন্তু কোনো গ্রাহক আসেনি। তিনি তার আগের নিয়মিত ক্লায়েন্টদের ফোন করেন। কিন্তু তারা তার দোকানে আসতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, যে কেউ আসতো তাকে  হুমকি দেয়া হতো। উল্টো দিকের ড্রাই-ক্লিনারের কাছে যেতে বলা হতো।

হাসানের পরিবারও নতুন নন্দনগরে সংগ্রাম করেছে, যেখানে তাদের ধর্ম তাদের আলাদা করে তুলেছে। তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে স্কুলে ‘তার ধর্মের কারণে’ ধমক খেয়েছে। তার এক সহপাঠী তাকে বলেছে, তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা উচিত। কারণ সে একজন মুসলিম।

হাসান এবং শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মুসলিমদের জন্য ন্যায়বিচার এখনও অধরা। ১লা সেপ্টেম্বরের হামলার পর উত্তরাখণ্ড পুলিশ নন্দনগর থানার প্রধান সঞ্জয় সিং নেগির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। তিনি তার অভিযোগে লিখেছেন, আমি দেখলাম ২৫০-৩০০ জন লোক জোরে জোরে ‘একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়’কে গালিগালাজ করছে। আমি যখন তাদের থামানোর চেষ্টা করলাম, তারা আমাকে একপাশে ঠেলে দিলো। তারপর আমি আমার সিনিয়রদের ডেকে অতিরিক্ত পুলিশ চাই। তিনি এরপর লিখেছেন, ‘জনতা মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর শুরু করে এবং একটি মসজিদও ভাঙচুর করে। উত্তেজিত জনতা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছিল। এর ফলে এই পরিবারের মহিলা এবং শিশুরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে।’ নেগি লিখেছেন- জনতা লাঠি, বেলচা এবং লোহার রড বহন করছিল। তবুও, উত্তরাখণ্ড পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। আল- জাজিরা চামোলি জেলার পুলিশ সুপার সর্বেশ পানওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি।

এখানে মুসলিমদের দোকানপাট লুটপাট করা হয় অথবা পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক বয়কট শুরু করা হয়। প্রায়শই মুসলমানরা শারীরিক সহিংসতারও সম্মুখীন হন। অতিসম্প্রতি, ধামির সরকার একটি অভিন্ন দেওয়ানিবিধি-এর নিয়মাবলী অবহিত করেছে- যা রাজ্যে মুসলিম এবং অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম-ভিত্তিক ব্যক্তিগত আইন অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখে। আদালত বেশ কয়েকবার হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু কিছু কর্মী মনে করেন যে, তাদের আরও কিছু করা দরকার। হাসানকে হাইকোর্টে একটি আবেদন করতে সাহায্য করেছেন দেরাদুনের একজন কর্মী খুরশিদ আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশের আদালত বুঝতে পারে না যে, মুসলিমরা বর্তমানে কতটা নিপীড়নের মুখোমুখি। নিপীড়ন সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে- শারীরিক, মানসিক, আর্থিক।
তবুও হাসান আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন।

সেপ্টেম্বরের সহিংসতার পাঁচ মাসেরও বেশি সময় পরে ১৯শে ফেব্রুয়ারি মুসলিম বিরোধী বিক্ষোভের নেতৃত্বদানকারী একজন হিন্দু ব্যক্তি হাসানের দোকানে আসেন। তার স্ত্রী সেই সময় তাদের দোকান পরিচালনা করছিলেন। হিন্দু ব্যক্তিটি একটি কোট এবং ট্রাউজার এনেছিলেন এবং জিজ্ঞাসা করেন যে- এগুলো কি দ্রুত ড্রাই-ক্লিন করা যেতে পারে কিনা। হাসানের স্ত্রী তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি আমাকে বোন ডেকেছিলেন। আর আপনি চান মুসলিমরা চলে যাক?
লোকটি উত্তর দিলো- যা হয়েছে ভুলে যাও। তোমার কাজ খুব ভালো। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি।
হাসান সেই ঘটনাটি মনে করে হেসে বলে, আমি এই দিনটি দেখেছি। কারণ আমি পালিয়ে যাইনি এবং লড়াই করেছি। তিনি বলেন, ভাঙা বন্ধুত্বের যন্ত্রণা এখনও কষ্ট দেয়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.