অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ছেই: সক্রিয় আন্ডারওয়ার্ল্ড by সুদীপ অধিকারী

রাজধানীতে একের পর এক গোলাগুলির ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোথাও আধিপত্য বিস্তারে তো কোথাও চাঁদার দাবিতে। এমনকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে গায়ে ধাক্কা লাগলেও বাড়িতে ঢুকে গুলি করা হচ্ছে। কারও পায়ে, কারও হাতে, কেউ আবার পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে।

গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সুতি খালপাড় এলাকায় মোহাম্মদ জাহিদ (২৫) নামে এক যুবকের পায়ে গুলি করা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে ঢামেকে নিয়ে আসা মো. হৃদয় বলেন, পায়ে গুলি লেগে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল জাহিদ। পরে আমরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। খুব সম্ভবত ছিনতাইকারীরা তাকে গুলি করে থাকতে পারে। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৩টার দিকে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ই-ব্লকের ১ নম্বর রোডে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মো. জসিম উদ্দিন (৪৪) ও তার বোন শাহিনুর বেগম (৩২)কে গুলি করা হয়। আহত অবস্থায় তাদের দু’জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। আহত জসিম উদ্দিন বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় থাকেন। সেখানে তার ফার্নিচারের ব্যবসা আছে। মিরপুরে তার বোন শাহিনুর থাকেন। এক সপ্তাহ আগে গাজীপুর থেকে বোনের বাসায় আসি। সপ্তাহখানেক আগে সোহাগ নামে ওই এলাকার এক ছিনতাইকারীকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করি। তখন তার সহযোগীরা আমাকে হুমকি দেয়। এরপর শবেবরাতের রাতে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বোনের বাসার সামনে এলে সোহাগের বিষয় নিয়ে এলাকার শরিফ, তুহিন, শহিদুল, সুজন, রিয়াজের সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটি হয়।

একপর্যায়ে শহিদুল আমার পায়ে গুলি করেন। খবর পেয়ে আমার বোন শাহিনুর বাসা থেকে বের হয়ে এলে তাকেও গুলি করা হয। স্থানীয়রা আমাদের প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরার বনশ্রীতে ডান পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রামপুরা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জুয়েল সরদার (৪০)। তাকেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত জুয়েলকে হাসপাতালে নিয়ে আসা বন্ধু মহসিন জানান, তারা বনশ্রী এ- ব্লক কাঁচা বাজারের পাশে কয়েক বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলযোগে হেলমেট পরিহিত বেশ কয়েকজন এসে হিমেল নামের একজনের খোঁজ করেন। তারা বলেন, আমরা হিমেল নামে কাউকে চিনি না।’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা জুয়েলের ডান উরুতে গুলি করে চলে যায়। বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার রামচর গ্রামের হাকিম সরদারের ছেলে জুয়েল বর্তমানে পূর্ব রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ভোরে হাতিরঝিলে মো. সুমন (২৫) নামে এক ইন্টারনেট কর্মচারীকে গুলি করা হয়। তাকেও উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তার বোন ইভা বলেন, আমার ভাই ইন্টারনেট কোম্পানিতে লাইনম্যানের কাজ করেন।

 মঙ্গলবার রাতে রামপুরা ওয়াপদা রোডের একটি চায়ের দোকানের সামনে ১২-১৫ জন মুখোশধারী মোটরসাইকেলযোগে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে আমার ভাই ডান পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হন। প্রথমে তাকে উদ্ধার করে মুগদা হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। আমাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার কুতুমপুর গ্রামে। বর্তমানে আমরা রামপুরার ওয়াপদা রোডের দুই নম্বর গলি এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকি। এর দুইদিন আগে ১লা ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ১০টার দিকে হাতিরঝিল থানার উলন পোড়াবাড়ি এলাকায় লানী (৫৫) ও শুভ (১৭) নামে দু’জন গুলিবিদ্ধ হন। তারাও ঢামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ জিলানির ছেলে সাইফুল বলেন, আমার বাবা উলন পোড়াবাড়ি এলাকায় কলা বিক্রি করে। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ একটি পক্ষকে আরেক পক্ষের লোকজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধাওয়া করে। সেই গুলি আমার বাবার গায়ে এসে লাগে। এ সময় শুভ নামে আরও একজন গুলিবিদ্ধ হন। তবে কে বা কারা আমার বাবাকে ও ওই কিশোরকে গুলি করেছে, বিষয়টি বলতে পারছি না। আমাদের বাড়ি বি-বাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার কমলপুর এলাকায়। আর গুলিবিদ্ধ শুভর বাড়ি শরীয়তপুরের ডামুড্যা থানার কাচিকাটা এলাকায়।

গত ২৪শে জানুয়ারি রাত সোয়া ১১টার দিকে কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধ এলাকায় সজল রাজবংশী (৩৭) নামে এক ব্যবসায়িকে গুলি করে প্রায় ৭০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ সজলের ভাই জয় রাজবংশী বলেছেন, ‘আমার ভাই কামরাঙ্গীরচরে ‘ইতি জুয়েলার্সের’ মালিক। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে দোকান বন্ধ করে মোটরসাইকেলে করে হাজারীবাগে বাসায় ফিরছিল বড় ভাই। বাসার কাছাকাছি এলেই অজ্ঞাত কয়েকজন দুর্বৃত্ত আমার ভাইয়ের বাম পায়ে গুলি করে তার কাছে থাকা প্রায় ৭০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ৭ই ডিসেম্বর কদমতলী এলাকায় একটি রড তৈরি কারখানার দুই নিরাপত্তাকর্মী মো. মনির (৪৫) ও মো. আল আমিন (৪০) দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন। কারখানাটির তত্ত্বাবধায়ক মো. সবুজ বলেন, রাত ২টার দিকে বাইরে মানুষের শব্দ পেয়ে দু’জন টর্চলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে যান। তখন এক ব্যক্তি তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে পালিয়ে যান। তাদের পায়ে গুলি লাগে। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই রাতে ৯টার দিকে ঢাকার পশ্চিম মেরুল বাড্ডা এলাকায় সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। তার ডান পায়ের উরুতে গুলি লাগে।

সাইফুলের খালাতো ভাই মনির হোসেন বলেন, কী কারণে কারা তার ভাইকে গুলি করেছে, সেটা এখনো জানতে পারেননি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে সাইফুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একের পর এক এমন গুলির ঘটনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, আগে কিছু হলেই ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমানে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপকহারে দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর একসঙ্গে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের লোকজনই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে এই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করছে। কেউ কেউ আবার দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে দোকান-বাসা বাড়ির সামনে ও নির্মাণাধীন ভবনের সামনে দল বেঁধে এসে গুলি চালানো হচ্ছে। ইন্টারনেট, ডিশ লাইন ও ময়লার ব্যবসার দখল নিতেও পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি হচ্ছে। এদিকে থানা লুটের অস্ত্রও এখনো সব উদ্ধার হয়নি। সেসব অস্ত্র নিয়েও কেউ কেউ ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে।

তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, নগরবাসীর নিরাপত্তার জন্য যা যা উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন আমরা সব নিয়েছি। চেকপোস্ট, পেট্রোল, ফুট পেট্রোল, ডিবি-পুলিশ-র?্যাব-সেনাবাহিনীর টহলসহ যা যা করণীয় আমরা সবকিছু করে যাচ্ছি। ডিএমপি, গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাই সন্ত্রাসীরা যত শক্তিশালীই হোক, সে যেই হোক পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।

এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমাদের ডিএমপি’র সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র‌্যাব, এপিবিএন, এটিইউ সকল এজেন্সি যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। এর আগে আমরা যৌথভাবে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করি। চিহ্নিত অপরাধীদের তালিকা করে সেই মোতাবেক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের যদি আটকাতে পারি, তাহলে দেখবেন ঘটনা কমে গেছে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, এখানে একটি ঘটনা ঘটলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। অপরাধ যে কখনো ছিল না, তা তো না। কিন্তু তখন যেহেতু মিডিয়া এত অ্যাডভান্স ছিল না, সেজন্য প্রচারটা হতো না। ইভেন আগে যে একটা ঘটনা ঘটলে একজন সামনে এগিয়ে এসে প্রতিরোধের চেষ্টা করতো, এখন সেটা না করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ভিডিওতে ব্যস্ত। তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা জনবহুল একটা শহর, এখানে সবাইকে অবদান রাখতে হবে। ঢাকাবাসীর সবার কাছে অনুরোধ, আসুন সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে আমরা চেষ্টা করি।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক ও সজাগ রয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থাপিত চেকপোস্টগুলোও ফাংশন করছে। যৌথ বাহিনীর অপারেশনও ভালোভাবে চলছে। থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিং করার জন্য বাহিনীর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের অফিসারদেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ফোর্স ও টহলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

No comments

Powered by Blogger.