গৃহপরিচারিকা থেকে সিইও, এক মায়ের সফল জীবন সংগ্রামের কাহিনী

মারিয়া পাজ বানাগ-মার্কেজ এমন একজন মা যার শক্তি, আত্মত্যাগ তার সন্তানদের সঙ্গে অটুট বন্ধন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ৫৮বছর বয়সে এসে ফিলিপিন্সের বাসিন্দা মারিয়া পাজ কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী নন, অটুট অধ্যবসায়ের অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণও বটে। তিন সন্তানকে একা বড় করা থেকে শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত জুড়ে সাতটি সফল প্যাস্ট্রি শপের গর্বিত মালিক হওয়া পর্যন্ত তার যাত্রা ভালোবাসা এবং সংকল্পের শক্তিতে ভরপুর। কুইজন প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মারিয়া পাজের জীবন স্বাভাবিকভাবেই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কেটেছে। একটি সাধারণ পরিবারে ১২ ভাইবোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা, যেখানে তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক এবং মা একজন গৃহিণী। মারিয়া পাজ প্রথম দিকে শিখেছিলেন যে বেঁচে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগের প্রয়োজন। কিন্তু তার জীবন যাত্রা সত্যিকার অর্থে শুরু হয়েছিল যখন তিনি কন্যা সন্তান জামাইকার মা হয়েছিলেন। জন্ম থেকেই  প্রতিবন্ধী জামাইকা বছরের পর বছর চিকিৎসাজনিত নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছে।

একজন মায়ের প্রতিবন্ধী শিশুকে বড় করে তোলার লড়াই

মারিয়া পাজ যখন জামাইকার জন্ম দেন, তখন তার মেয়ের জন্মগত ত্রুটি ধরা পড়ে। মেয়েকে বড় করে তোলার জন্য বছরের পর বছর ধরে একাধিক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। পাঁচ বছর বয়সে জামাইকার মুখের ভেতরের অংশ মেরামত করার জন্য প্রথম অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ১২বছর বয়সে তার চোখের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল এবং পরে তার হার্টের একটি ছিদ্র মেরামত করতে একটি হার্ট সার্জারির প্রয়োজন হয়।

মারিয়া পাজ নিদারুণ সমস্যার মধ্যে পড়ে যান। তার নিজের শহরে গড়ে তোলা ছোট বেকারি শপটি মেয়ের চিকিৎসার প্রয়োজনগুলো পূরণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। মারিয়া পাজ সেদিনের কথা মনে করে বলছেন, ‘মেয়ের হার্ট অপারেশনের জন্য আমার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না এবং সেটি আমার হৃদয়কে চুরমার করে দিচ্ছিলো। আমি আমার মেয়ের কষ্ট দেখতে চাইনি, তাই আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আমাকে কাজের জন্য বিদেশে যেতে হয়েছিল।’

২০০৫  সালে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মারিয়া পাজ তার সন্তানদের পেছনে ফেলে সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার কাজ করার জন্য চলে যান। মারিয়া বলছেন, ‘আমি জামাইকার অপারেশনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে দুই বছর সৌদি আরবে কাজ করেছি। প্রতিদিন, আমি আমার বাচ্চাদের কথা ভাবতাম, বিশেষ করে জামাইকার কথা, কারণ সন্তানেরাই আমার সবকিছু ছিল।’

ভালোবাসা ও সংকল্পের যাত্রা

মারিয়া পাজ ফিলিপিন্সে ফিরে আসেন, কিন্তু তার মেয়েকে সুস্থ করে তোলার লড়াই তখনো শেষ হয়নি। ২০০৮ সালে, তিনি দুবাইতে চলে যান, যেখানে তিনি উম্মে সুকিমে এক ফরাসি দম্পতির বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মারিয়া পাজ তার সন্তানদের বড় করার জন্য ফিলিপিন্সে অর্থ পাঠিয়ে গেছেন। সেইসঙ্গে পরিবারের সঙ্গেও তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে উঠেছে। তার বড় মেয়ে প্যাট্রিস মেরি নেদারল্যান্ডে যাওয়ার আগে সাত বছর দুবাইতে কা/জ করেছিলেন। তার ছোট ছেলে জন প্যাট্রিক ম্যানিলায় স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। কিন্তু মারিয়া পাজের জীবনে চালিকা শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে জামাইকা।  

মারিয়ার কথায়, সে সবসময় আমার মনে ছিল। আমি তাকে সুস্থভাবে বড় করে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেছি। যখন আমার নিয়োগকর্তা ২০২১ সালে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে এটাই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। আমার বেকিংয়ের প্রতি একটা আবেগ ছিল এবং আমি জানতাম যে এটি আমাদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ।

একজন গৃহকর্মী থেকে একজন বেকারির মালিক

২০২১ সালে তার নিয়োগকর্তা চলে যাওয়ার পরে মারিয়া পাজ দুবাইয়ের সাতোয়া এলাকায় মারিয়া পাজ পেস্ট্রি নামে কটি ছোট বেকারি খোলার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। সেদিনের কথা মনে করে মারিয়া বলেন, ‘আমার কোনও পুঁজি ছিল না, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার কাছে যা ছিল তা ছিল আমার বেকিং দক্ষতা। কলেজ চলাকালীন একটি বেকারিতে পার্টটাইম  কাজ করার সময় তিনি এই কাজটি শিখেছিলেন। ফিলিপিন্সে একটি ছোট বেকারি পরিচালনা করেছিলেন। তার তৈরি চিজকেকগুলো, বিশেষ করে টিকটক এবং ফেসবুকে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র ফিলিপিনোদের মধ্যেই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেও খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মারিয়া পাজ বলছেন, ‘এই বেকারি শপটি পরিচালনা করার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানুষদের কাছে আমার বাড়িতে তৈরি করা পেস্ট্রির রেসিপিগুলো ভাগ করে নিতে পারি। এটি খাবারের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমার ভালোবাসার বন্ধন গড়ার একটি প্রয়াস।’

মারিয়া পাজ তার আত্মীয়দের সঙ্গে অংশীদারিত্বর মাধ্যমে দোকান চালানোর অর্থ জোগাড় করেছিলেন। আর্থিক সংস্থাগুলো থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। মারিয়া বলছেন, আমার এক বছরের জন্য কোনও বেতন ছিল না। আমরা শুধুমাত্র আমাদের করা সামান্য লাভের ওপর বেঁচে ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম যে আমার পরিবারকে সমর্থন করার জন্য আমাকে এ চেষ্টা  চালিয়ে যেতে হবে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বেকিংয়ে প্রতি অধ্যবসায় এবং ভালোবাসা আমার ঋণ পরিশোধ করতে সাহায্য করেছে।’

ধীরে ধীরে দুবাইতে জনপ্রিয় হতে থাকে মারিয়ার বেকারিটি। তার বাড়িতে তৈরি চিজকেক এবং পেস্ট্রির প্রতি অনেকেই আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। মাত্র চার বছরে মারিয়া পাজ একজন গৃহপরিচারিকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি প্যাস্ট্রি দোকানের মালিক হয়ে ওঠেন। তিনি তার দোকানে ৭০ জনেরও  বেশি কর্মী নিয়োগ করেছিলেন, বেশিরভাগই ফিলিপিনো। তবে এই সাফল্য একদিনে আসেনি। বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ এবং তার সন্তানদের জন্য একটি ভাল ভবিষ্যৎ প্রদানের আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে এই সংগ্রামের নেপথ্যে।  

মায়ের জয়: অসুস্থ কন্যাকে সুস্থ করা, একটি স্বপ্ন পূরণ

অবশেষে জামাইকার সার্জারির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন মারিয়া। তিনি অশ্রুসজল গলায় বলে চলেন, ২৩ বছর পর আমি অবশেষে আমার মেয়ের অবস্থা ঠিক করতে পেরেছি। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়। প্রতিটি ত্যাগ, প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাকে এই মুহূর্তের দিকে নিয়ে গেছে।

মারিয়া পাজ জামাইকার অস্ত্রোপচারের জন্য এক মিলিয়ন পেসো খরচ করেছেন, যার সবটাই এসেছে তার বেকারি থেকে। ‘আমার বেকারি না থাকলে এর কিছুই সম্ভব হতো না’- আবেগসিক্ত গলায় বলে চলেন এই লড়াকু মা।  

আশা ও অধ্যবসায়ের বার্তা

আজ মারিয়া পাজ শুধু একজন সফল উদ্যোক্তা নন; তাদের জন্য তিনি আশার আলো যারা জীবনে একাধিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছেন। তার গল্প প্রমাণ করে-আপনি যেখান থেকেই শুরু করুন না কেন, দৃঢ় সংকল্প, ভালোবাসা এবং জেদের দ্বারা সবকিছুই করা সম্ভব। মারিয়া পাজের কথায়, হাল ছেড়ে দিও না। কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাও। একদিন স্বপ্ন সত্যি হবেই।

No comments

Powered by Blogger.