দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি by ইমরান মালিক

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে (পুনরায়) উদীয়মান ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ককে তাদের যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে যেতে হবে। অতীত এবং বর্তমান, বাস্তব এবং অনুভূত সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তাদের অবশ্যই একটি স্থায়ী সম্প্রীতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। তাদের অবশ্যই দুই দেশের মধ্যে সংশয় ও ফাটল সৃষ্টির (পুনরায়) কৌশলমূলক প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, সামরিক, খেলাধুলা, শিক্ষা এবং পর্যটনসহ এই সম্পর্কগুলোকে বহুমাত্রিক হতে হবে। তাদের অবশ্যই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্থাপন করতে হবে, একে অপরের অর্থনীতিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে, ভিসামুক্ত ভ্রমণের প্রচার করতে হবে, সরাসরি ফ্লাইট এবং সামুদ্রিক সংযোগ পুনরায় চালু করতে হবে এবং রাজনীতিবিদ, পণ্ডিত, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ এবং জনগণকে পারস্পরিক সফরের সুবিধা দিতে হবে। পাকিস্তান-বাংলাদেশ পুনর্মিলনের লক্ষ্য অবশ্যই দুই দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক (পুনরায়) সম্পৃক্ততা তৈরি করা এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন পুনরুদ্ধার করা। তারা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও সহযোগিতা শুরু করতে পারে।

পাকিস্তানের নিজস্ব শক্তিশালী সামরিক-পরমাণু-ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সক্ষমতা বারবার প্রদর্শন করে এসেছে দেশটি। পাকিস্তান সর্বদা তার প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে কার্যকরীভাবে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে এসেছে।পাকিস্তান শুধুমাত্র অত্যন্ত পেশাদার, সুশৃঙ্খল, যুদ্ধে দক্ষ, সুসজ্জিত এবং সু-প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারীই নয়, পাশাপাশি সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক এবং সামরিক ইচ্ছাও প্রদর্শন করেছে। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে, এটি বহিরাগত আগ্রাসন রোধে বাংলাদেশকে অনুরূপ সামরিক শক্তির বিকাশ ও সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করতে পারে।

পাকিস্তানের একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স রয়েছে যা বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই JF-17 ব্লক থ্রি বিমানে আগ্রহ দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সাপেক্ষে পাকিস্তানও নৌযান, যান্ত্রিক/সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, ড্রোন, আর্টিলারি বন্দুক, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্র এবং এমনকি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক এবং স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার কথা বিবেচনা করতে পারে। সামনে সুযোগ সীমাহীন। তাই সহযোগিতার পরিধিও সীমাহীন হওয়া উচিত।

অন্যদিকে, ভারত তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এই নতুন বন্ধুত্ব দেখে শঙ্কিত হতে পারে। ভারত যখন তাদের আলাদা রাখার প্রচেষ্টা করে এসেছে তখন এই অপ্রত্যাশিত উন্নয়ন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। উদীয়মান ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ভারত অবিলম্বে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত যখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে তখন ‘প্রজেক্ট বাংলাদেশ’ তার হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বড় ধাক্কা। ভারত ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এবং এখন বাংলাদেশসহ প্রায় সমস্ত প্রতিবেশীর ওপর তার প্রভাব হারিয়েছে। ভারত তার প্রভাবের ক্ষেত্র থেকে অনেকটাই বেরিয়ে গেছে। তাই  শুধু বাংলাদেশের দ্বারা উদ্ভূত ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই নয়, বরং এই অঞ্চলের অন্যত্র নিজের হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে স্পষ্টতই এটি পশ্চাদপসরণ!

তাহলে, দক্ষিণ এশিয়ার এই ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে ভারতের সামনে বিকল্প কী আছে? প্রথমত, ভারত বর্তমান স্ট্যাটাস মেনে নিতে পারে। কিন্তু তা অসম্ভব, কারণ ভারত বরাবর আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও তার জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে ভারত। একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধের মৃত ঘোড়াকে নিরলসভাবে চাবুক মারা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণ এখন তাদের দুর্ভাগ্যজনক অতীতকে অতিক্রম করে একটি উজ্জ্বল, পারস্পরিকভাবে সুরক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে পারে। ভারতের এ ধরনের প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

তৃতীয়ত, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কূটনীতির পাশাপাশি পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধের সুবিবেচিত কৌশল অবলম্বন করতে পারে।  এর মধ্যে মিডিয়া এবং কূটনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি বাণিজ্য যুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এটি সীমান্ত সমস্যা, পানি বণ্টন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, অভিবাসন এবং অন্যান্য বিষয়েও বাংলাদেশকে চাপ দেয়া  শুরু করতে পারে।

পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস এবং অন্যান্য উপায়ে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণভাবে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে। এটি ভারতের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য পদ্ধতি বলে মনে হচ্ছে। চতুর্থত, শেষ অবলম্বন হিসাবে, ভারত বাংলাদেশের বুকে  সামরিক হস্তক্ষেপ এবং/অথবা ঢাকায় শাসন পরিবর্তনের চেষ্টা করার কথাও বিবেচনা করতে পারে। তবে এটি সম্ভবপর হবে বলে মনে হচ্ছে না, কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিপুল জনসমর্থন উপভোগ করছে। ভারতের এই ধরনের কৌশল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের থেকে কোনো সমর্থন পাবে না বলেই অনুমান। ভারত এইভাবে সীমান্ত বিরোধ অথবা তার ভৌগোলিক উত্তেজনাপূর্ণ উত্তর-উত্তরপশ্চিম এবং পূর্ব-উত্তরপূর্ব- উভয় ক্ষেত্রেই গতিশীল ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে পড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না যে কোয়াডের- সদস্য হিসাবে ভারত  নির্ধারিত প্রতিপক্ষ ছাড়া অন্য কারো বিরুদ্ধে তার সময়, প্রচেষ্টা এবং শক্তি ব্যয় করুক।

ভারত স্পষ্টতই বাংলাদেশে এবং অন্যান্য প্রতিবেশীদের মধ্যে তার দৃঢ় উপস্থিতি এবং প্রভাব হারিয়েছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভারতকে আরও আধুনিক, বাস্তবসম্মত এবং প্রাসঙ্গিক নীতি কাঠামো তৈরি করতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে, চীন এখন শুধু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তি নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তি হিসেবেও আবির্ভুত হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর মাধ্যমে,  ভারতকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করছে চীন। যার জেরে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব হারাতে চীন একাই ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে। এগুলি হল ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত বাস্তবতা যা ভারতকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে।

যতদিন চীনের ফ্যাক্টর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাসঙ্গিক থাকবে, ততদিন এই অঞ্চলের অবিসংবাদিত আধিপত্য হওয়ার ভারতের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকবে। এমনকি দূরবর্তী শক্তির সমর্থন, সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, এই উদীয়মান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ফ্যাক্টর নাও হতে পারে। এর জেরে ভারত কি আরও মার্কিন শিবিরের দিকে ঝুঁকবে?  দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কি হতে পারে তা সত্যিই অনুধাবন করা কঠিন।

লেখক-  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার
সূত্র : দ্য নেশন

No comments

Powered by Blogger.