পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং by শুভ্র দেব
সূত্রমতে, এক যুগ আগে ঢাকার অলিগলিতে শুরু হয় কিশোর গ্রুপিং। এলাকাভিত্তিক ছোটখাটো বিভিন্ন অপরাধ দিয়ে কিশোরদের যাত্রা শুরু হয়। একপর্যায়ে এই গ্রুপগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিটি গ্রুপের আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে তাদের বিস্তারও বাড়তে থাকে। এলাকার চোর, ছিনতাইকারী, শ্রমিক, দিনমজুর, বখাটে, মাদকাসক্ত, পথশিশু থেকে শুরু করে এক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এসব গ্রুপে সদস্য হয়ে গ্যাং তৈরি করে। প্রতিটি এলাকার কাউন্সিলর, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এসব গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। তাদের শেল্টারেই এসব গ্যাং সদস্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াতো। থানা পুলিশের ঝক্কিঝামেলা এলে শেল্টারদাতা বা পৃষ্টপোষকরা ম্যানেজ করতেন। মূলত পৃষ্ঠপোষকরা তাদের হাত শক্তিশালী করার জন্য গ্যাং সদস্যদের হাতে রাখতেন। তারা নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন অপরাধে কিশোর অপরাধীদের ব্যবহার করতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই কিশোর গ্যাং সদস্যরাই এখন ঢাকার অপরাধ জগতে প্রতাপ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দেওয়াতে কিশোরদের হাতে চলে গেছে এখন অপরাধের চাবি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি। ঢাকায় যেসংখ্যক গ্রুপ থাকার কথা বলা হয়েছে বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুব একটা মিলে না। তবে ঢাকায় অপরাধ জগতের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত এমন ৫০টির মতো কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা মিলেছে। এরমধ্যে উত্তরা এলাকায় ২৩টি গ্যাং সক্রিয়। এদের মধ্যে, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রণো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং, শাহীন-রিপন গ্যাং ও নাজিম উদ্দিন গ্যাং বেশি সক্রিয়। তেজগাঁও এলাকায় সক্রিয় মাঈনুদ্দিন গ্রুপ। মিরপুর-১১ এবং ১২ নম্বর এলাকায় বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্ছু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলের গ্যাং, সি-ব্লকে সাব্বির গ্যাং, ডি-ব্লকে বাবু রাজন গ্যাং, চ-ব্লকে রিপন গ্যাং, ধ-ব্লকে মোবারক গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং। ধানমণ্ডিতে ৪টি গ্রুপ সক্রিয়। এদেরমধ্যে নাইন এমএম, একে- ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, রায়ের বাজারে স্টার বন্ড গ্রুপ। তুরাগে তালাচাবি গ্যাং। মোহাম্মদপুরে গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল- চিনে ল, কোপাইয়া দে, ঝিরঝির গ্রুপ এবং ভাইব্বা ল গ্রুপ, ‘পাটোয়ারী গ্রুপ’ ‘আতঙ্ক গ্রুপ’ ‘চাপায়-দে আটিপাড়ায়, শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, খ্রিস্টানপাড়ায় সোলেমান গ্যাং, ট্রান্সমিটার মোড়ের রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং। হাজারীবাগে বাংলা ও গেণ্ডারিয়ায় লাভলেট। বংশালে জুম্মন গ্যাং। মুগদায়, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভাণ্ডারী গ্যাং। চকবাজারে, টিকটক গ্যাং ও পোঁটলা সিফাত গ্যাং সক্রিয়। শ্যামপুরে ফইন্নী গ্রুপ।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। গ্যাং লিডারদের বয়স সাধারণ ২০ এর উপরে থাকে। প্রতিটি গ্রুপে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য রয়েছে। বড় গ্রুপগুলোতে সদস্য আরও বেশি হয়। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে চোর, মাস্তান, ছিনতাইকারী, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এমনকি অভিজাত ঘরের সন্তানও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ পশ্চিমা কালচারে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার কেউ কেউ এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের প্রভাবে বাধ্য হয়ে গ্যাং এ জড়িয়ে পড়ছে। শুরুটা স্বাভাবিক হলেও একসময় তাদের পোশাক, আচরণ, কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যা দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্য সমাজের সঙ্গে একেবারে মানানসই নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিত্য-নতুন ধারার অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। বিশেষ করে ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কর্মকাণ্ড বেশি বেপরোয়া। তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, গভীর রাতে মাদকাসক্ত হয়ে কার ও মোটরসাইকেল রেসিং, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর এজেন্ট, শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই এমনকি ভাড়ায় কিলিং মিশনে অংশ নিচ্ছে। একই এলাকায় একাধিক গ্রুপ হওয়াতে আধিপত্য বিস্তারে তারা মরিয়া হয়ে থাকে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তারা প্রায়ই সংঘাত-সংঘর্ষে জড়ায়। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য তারা শক্তিশালী অবস্থান নেয়। দেশি- বিদেশি অস্ত্র ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দেয়। বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য মারামারির ভিডিও আপলোড করে। কিশোর গ্যাংয়ের নানা সংঘাতে খুন পর্যন্ত গিয়ে গড়িয়েছে- এমন ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
সূত্রমতে, ইন্টারনেটের ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াট্সঅ্যাপ, ভাইভার ইমোতে গ্রুপ করে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। কর্মপরিকল্পনা থেকে শুরু করে হুমকি, নির্দেশ সবকিছুই তারা ইন্টারনেটের সুবাধে সেরে নিচ্ছে। ইন্টারনেটই তাদের মূল হাতিয়ার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে এখন আগ্নেয়াস্ত্র প্রায়ই দেখা যায়। এসব অস্ত্র দিয়েই তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। সরকার পতনের পর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে রয়েছে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। এছাড়া আধুনিক ধারালো অস্ত্র যেমন চাপাতি, বেঁকি, বার্মিজ চাকু, কিরিচও রয়েছে। ডিএমপি’র প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রায় ৪০ শতাংশই কিশোর। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় অন্তত ২০ হাজারের মতো কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত।
মাস দুয়েক আগে বিকালে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন টিনশেড বাড়ির ওপর এক কিশোরকে চার-পাঁচ জনের কিশোর গ্রুপ চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্যে কোপাতে দেখা যায়। মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের ফুটপাতে গভীর রাতে এক পথচারীর কাছ থেকে ছিনতাই করার সময় চাপাতি বাহিনীর চকচকে চাপাতি প্রদর্শনের দৃশ্যও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। গত মাসে যাত্রাবাড়ীতে রিকশায় এক দম্পতির কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় চাপাতি বাহিনী। এ সময় চাপাতির আঘাতে স্বামী গুরুতর আহত হন। গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে গ্যাং গ্রুপের কয়েকশ সদস্য। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন। পহেলা ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য চাপাতি দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে আহত হন পুলিশের চার জন সদস্য। হামলার ঘটনার নেপথ্যে রায়েরবাজার বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত বলে জানায় পুলিশ। নেতৃত্ব দেয় ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। সব মিলিয়ে হামলা চালায় ৩০-৪০ জন। গত সপ্তাহে সোমবার রাতে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে রিকশা যাত্রী মেহেবুল হাসান ও নাসরিন আক্তার ইপ্তির ওপর চাপাতি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় মেহেবুলের সামনে নাসরিন দাঁড়িয়ে চাপাতি বাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা করে। এই হামলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে বুধবার রাত ১১টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে সড়কে এক রিকশাযাত্রী দম্পতিকে চাপাতি বাহিনী তাদের চাপাতি দেখিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করে মোটরসাইকেলে চলে যায়। মোহাম্মদপুর, উত্তরারা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সবাই। কিছুদিন পরপরই তারা গণছিনতাই করে। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। অস্ত্র ঠেকিয়ে মানুষের সবকিছু লুটে নেয়। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে ভয় পান অনেকে। যেকোনো কিছুতে তারা চাঁদাদাবি করেন। না দিলে হুমকি দেন। মহড়া দেওয়ার সময় বাসাবাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর, লাইট ভাঙচুর করে গ্যাংয়ের সদস্যরা।
পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে উত্তরা, আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি স্থানে একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের কয়েক হাজার সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রোধ করতে রাজনৈতিক চাপ না থাকলেও প্রভাবশালীদের চাপ রয়েছে। যাদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে কিশোর গ্যাংয়ের গড ফাদাররা আইনের মারপ্যাঁচে সব সময় বেঁচে যান। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে যখন কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপতৎপরতা বেড়েছে তখনও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা খুব একটা চোখে পড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনতো হয়তো অদৃশ্য প্রভাবশালীদের চাপে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কিশোরগ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।

No comments