পানামা খালের ইতিহাস কী, যুক্তরাষ্ট্র কেন এটি খনন করেছিল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প পানামা খাল আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা বলেছেন। এই খাল লাতিন আমেরিকার দেশ পানামায় অবস্থিত এবং কয়েক দশক ধরে তারাই গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বাভাবিকভাবেই পানামার সরকার ট্রাম্পের ওই ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছে।

পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের আপত্তি দুটি। তাঁর মতে, খাল কর্তৃপক্ষ এটি ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘অত্যন্ত বেশি হারে’ মাশুল নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই খালের ওপর চীনের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। ট্রাম্প বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র উদার হাতে যেভাবে পানামাকে সহায়তা করছে, তারপরও দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে হারে মাশুল নেয়, তা ‘হাস্যকর’।

সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত এ খালটি ১৯১৪ সালে চালু করা হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে দেশটি পানামার সঙ্গে একটি চুক্তি করে খালটি তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য। তবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দুই দেশ যৌথভাবে পানামা খাল নিয়ন্ত্রণ করে।

পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, পানামা খাল ও এর আশপাশের প্রতি বর্গমিটার পানামার সম্পত্তি এবং ভবিষ্যতেও তা–ই থাকবে। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে দর–কষাকষি চলবে না।’

পানামা খালের শুরুটা যেভাবে


পানামা খাল খননের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মধ্যে জাহাজের চলাচল হতো কেপ হর্ন ঘুরে। এটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একেবারে দক্ষিণ বিন্দু। ফলে জাহাজগুলোকে অতিরিক্ত কয়েক হাজার মাইল ঘুরে চলাচল করতে হতো, কখনো কখনো এর জন্য কয়েক মাস লেগে যেত।

আমেরিকায় যেসব দেশ কলোনি স্থাপন করেছিল, তাদের কেউ কেউ চেয়েছিল এমন একটি জলপথ তৈরি করতে, যা আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে জাহাজ চলাচলের সময় কমিয়ে আনবে। তবে তাদের ওই চাওয়া কখনোই পূরণ হয়নি।

এরপর বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এমন একটি জলপথ তৈরি করাকে অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেন। এখন যেটি পানামা, তখন তা নিয়ন্ত্রণ করত রিপাবলিক অব কলম্বিয়া। কিন্তু মার্কিন–সমর্থিত এক বিদ্রোহে পানামা ও কলম্বিয়া ভাগ হয়ে যায়, ১৯০৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন দেশ পানামা প্রজাতন্ত্র।

সদ্য স্বাধীন দেশ পানামা ও যুক্তরাষ্ট্র ওই বছরই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আওতায় ১০ মাইল লম্বা একটি ভূখণ্ড মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এর বিনিময়ে অর্থ পায় পানামা। আর যুক্তরাষ্ট্র পায় একটি খাল খননের অধিকার।

খাল খননের কাজ শেষ হয় ১৯১৪ সালে। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সুপারপাওয়ার হিসেবে তখন যুক্তরাষ্ট্র সবার কাছ থেকে বাহবা পায়। কিন্তু এই খাল খননের জন্য বড় ধরনের মানবিক মূল্য দিতে হয়েছিল। এটির নির্মাণকালে ৫ হাজার ৬০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই খালের বাস্তব গুরুত্ব বোঝা যায়। সে সময় দুই মহাসাগরের মধ্যে মিত্রশক্তির জাহাজগুলো কম সময়ে চলাচল করতে পেরেছে। কিন্তু খালের নিয়ন্ত্রণ, পানামার শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ ও খালের এলাকায় দুই দেশের পতাকা একই সঙ্গে ওড়ানো হবে কি না, এমন প্রশ্নে পানামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

১৯৬৪ সালের ৯ জানুয়ারি উত্তেজনা চরমে ওঠে। সেদিন আমেরিকাবিরোধী দাঙ্গায় খাল এলাকায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। অল্প সময়ের জন্য দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ছেদ হয়। এরপর বছরের পর বছর ধরে আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

ওই চুক্তিতে পানামা খালকে নিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে সব জাহাজের জন্য এটি খোলা থাকবে। চুক্তি মোতাবেক, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত খালের নিয়ন্ত্রণ পানামা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যৌথভাবে থাকবে এবং এরপর তা পানামার হাতে চলে যাবে। তবে সবাই জিমি কার্টারের এই চুক্তি সমর্থন করেননি। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রোনাল্ড রেগান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ‘খালের এলাকার ন্যায়সংগত মালিক’।

পানামা খাল নিয়ে ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে আবারও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সে সময় পানামার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ম্যানুয়েল নরিয়েগা। তখন ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পানামায় সামরিক অভিযান চালায় এবং ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

নতুন ঝামেলা

২০০০ সালে খালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ওই জলপথের সক্ষমতার চেয়ে বেশি জাহাজ সেটি ব্যবহার করা শুরু করে। ২০০৭ সালে খালের বড় ধরনের সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় এক দশক পর। কিন্তু খালের এলাকায় ব্যাপক খরা দেখা দেওয়ায় পানির স্তর নেমে যায়, ফলে এটি পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ জাহাজ চলাচলের সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং মাশুল বৃদ্ধি করে।

সম্ভবত ওই অতিরিক্তি মাশুলের কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প অসন্তষ্ট।

তবে রাষ্ট্র হিসেবে পানামা ও খালের ওপর চীন আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ চাইছে ট্রাম্পের এই দাবির কিছুটা ভিত্তি রয়েছে। ২০১৭ সালে পানামা একটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করে, যাতে বলা হয় যে তারা তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখবে না। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এই ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে। সেই থেকে খালের এলাকায় চীনের প্রভাব বেড়েছে।

পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো অবশ্য বলেছেন, ‘খেয়াল খুশিমতো মাশুল নির্ধারণ করা হয়নি।’ চীন খালের ওপর প্রকাশ্যে নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইছে, এমন ধারণাও তিনি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘এই খালের ওপর চীন, ইউরোপীয় সম্প্রদায়, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো শক্তির পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’

পানামা খাল
পানামা খাল। ফাইল ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.