গল্প- জায়গিরদার ও তার কুকুর by পান্নালাল প্যাটেল

ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর জায়গিরদার এই প্রথম আমাদের গ্রামে আসছেন। সবাই তার আগমনের প্রতীক্ষায়। গায়ের তালাতি (হিসাবরক্ষক) সপ্তাহ ধরে দুধের ভাণ্ড ঠিক রাখছে। কে জানে, কখন বাপুজির অভ্যুদয় ঘটবে। চারপেয়ে চৌকি এবং কাঁথা স্তূপ করা হয়েছে। মুখির (গ্রামের মাতবর) ওপর হুকুম জারি হয়েছে এসময় তার গ্রাম ছেড়ে যাওয়া চলবে না। মুচি, নাপিত, ভিস্তি সকলকেই প্রতি মুহূর্তের জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ দিনভর-রাতভর পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যখন তারা খেতে যাচ্ছে, বদলা পুলিশ মোতায়েন করে যাচ্ছে।
আজ খুব সকালে জায়গিরদারের বাবুর্চি, কয়েকজন ভৃত্য ও বডিগার্ড এসে পৌঁছাতেই গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
বাবুর্চি রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়ে নিল, তাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামের চারজন পুরুষ নিয়োগ হলো। জায়গিরদারের সফরসঙ্গীদের ব্যবস্থাপনায় মুখি সারাক্ষণই ব্যস্ত। পুলিশরা রান্নার হাঁড়ি-পাতিল জোগাড় করতে, দুধ ও দই জোগাড় করতে গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে। যেসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না বানিয়ার দোকান থেকে কেনা হচ্ছে। খরচ যেভাবেই হোক, তা সম্মিলিতভাবে গ্রামবাসীকে বহন করতে হবে। জায়গিরদারের পরিচারক যা কিছু প্রয়োজন তার জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দিলো, যাতে সবকিছু ঠিকঠাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। গ্রামের দর্জি দালাকে দিয়ে পাঁচ বছর আগে সেলাই করা কোট ও চোগা পরে মাথায় গোলাপি পাগড়ি চাপিয়ে তালাতি অধৈর্য হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে আর নজর রাখছে রাস্তার ওপর – বাপুজি যদি এসে পড়েন!
হঠাৎ কেউ একজন বলল, ‘আমার মনে হয় গাড়ি আসছে’, আর তাতেই ধাবমান গাড়ির শব্দ শোনার জন্য সবাই কান খাড়া করে রাখল। রাস্তার বাঁকে বহু মানুষের সমাগম হলো। ‘এ যে আসছে… দেখতে পাচ্ছো না ধূলি উড়ছে… কিছুক্ষণ পর তোমাদের চোখে পড়বেই।’
পুলিশ জনতা সামলাতে ছুটল। ‘শালা সব আহম্মকের বাচ্চা, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিস ক্যান্? লাইন করে দাঁড়া। বেটা শয়তানের বাচ্চারা, এত হইচই কিসের! শান্ত হ। শুনতে পাচ্ছিস গাধার বাচ্চা গাধা, যখন বাপুজি আসবেন, কথা কানে ঢুকছে মূর্খের দল, যখন বাপু আসবেন সবাই মাথা নুইয়ে সম্মান দেখাবি।’
বাপুর গাড়ি এসে গেল, গ্রামবাসীর আনত মাথা ধুলোয় ভরে গাড়ি মাঠের পাশে থামল।
দরজা খুলে গেল, বাপু গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পরপরই নেমে এলো সাদা ধবধবে একটি জন্তু, খাটো পা, লম্বা কান, শরীরটা পশমে জড়ানো। পেছনের সিট থেকে নেমে এলেন বাপুর সেক্রেটারি।
জায়গিরদার একজন যুবক, বয়স আটাশের মতো। তার মুখমণ্ডল তেমন আকর্ষণীয় নয়, তবে শরীরটা সুগঠিত। আর তার পোশাকের স্টাইল অসাধারণ – ট্রাউজার্স, কোট, টাই, মোজা, জুতো, হাতঘড়ি, গগলস এবং চমৎকার একটি আংটি। তার এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে শেকলের মতো একটা কিছু। দেখে মনে হয় যেন এইমাত্র তিনি স্টিমার থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কিন্তু কেউই তার দিকে নজর দিচ্ছে না, যখন তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে তখনও না, তাদের সবার দৃষ্টি নিবন্ধ তার পায়ের কাছের ছোট অদ্ভুত জন্তুটির দিকে।
এমনকি তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথাবলাবলি করছে বিলাতফেরত জায়গিরদার কতটা বদলে গেছেন সে-আলাপে না গিয়ে জন্তুটির কথা বলছে। কেউ-কেউ বলেছে, এটা আসলে ইংরেজ খরগোশ। অন্যরা ভেবেছে, এটা সম্ভবত একটা কুকুর। বিস্মিত কেউ-কেউ অবশ্য এটাও বলেছে, এটা আবার ইংরেজ প্রজাতির চিতাবাঘ নয় তো! কেউ-কেউ মনে করেছে, এটা কুকুরও নয়, বিড়ালও নয়, খরগোশও নয়! কিন্তু এই অদ্ভুত জিনিসটা যে কী তাও নির্ধারণ করতে পারল না। আলোচনা প্রতিমুহূর্তেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেউ-কেউ এমনকি এই অদ্ভুত জিনিসটাকে নিয়ে বাজি ধরেছে।
খবরটা যতই ছড়াচ্ছে ততই জনতার ঢল নামছে। প্রতিটি নতুন মানুষ এসে জিজ্ঞেস করছে, ‘এই অদ্ভুত জন্তুটা আসলে কী?’ কয়েকজন তো সত্যি-সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। তারা বলল, ‘বাপুজির উচিত জন্তুটাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা, নতুবা এই জন্তু কাউকে মেরেও ফেলতে পারে।’
এর মধ্যে কয়েকজন যুবক সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে হাজির হলো। তারা জানালো, এটা আসলে একটা কুকুর। তারা এই কুকুরের নাম শুনে থাকলেও এখন তা গুলিয়ে ফেলেছে। একজন বলল, এই কুকুরের নাম শিভলার, অন্যজন  জোর দিয়ে বলল, এটার নাম শিভলো। তৃতীয়জন শিশু কিংবা ফিলু জাতীয় কিছু একটা বলল। অন্যদের কেউ-কেউ নাম নিয়ে মোটেও মাথা ঘামালো না, তারা কুকুরের বর্ণনা দিতে শুরু কলল, ‘কী সুন্দর একটা কুকুর। কান দুটো এত লম্বা যে মাটিতে লেগে যায়। আর পাগুলো কেমন খাটো-খাটো। হায় খোদা! চুলগুলো এমন কেন – সাধুদের জটপাকানো চুলের মতো! আবার কী ধবধবে সাদা।’ কেউ একজন বলল, ‘আমার মনে হয় এগুলো রুপালি চুল। একদিন শেঠজি বলেছেন ইংরেজ মহিলাদের নাকি সোনালি চুল। তাহলে কুকুরটার রুপালি চুলও হতে পারে। কেউ তো আর ঠিকঠাক বলতে পারে না। ইংল্যান্ডের মতো দেশে সবকিছুই সম্ভব!’
এসব নিয়ে সবাই হাসাহাসি করল আবার প্রত্যেকে নিজেকে এটাও শোনালো, ‘বাপুর মতো মানুষ তো আর বিদেশ থেকে নেড়ি কুত্তা নিয়ে আসার কথা নয়।’
সারাগ্রামের মানুষই কুকুর নিয়ে বলাবলি করছে, এমনকি মাঠের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে মহিলারাও মজার-মজার মন্তব্য করছে।
কিন্তু মুখি এসে সকলকে সতর্ক করে দিলো, ‘বাপুর কুকুর নিয়ে কেউ কোনো বাজে কথা বলবে না। বাপু তার কুকুরকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’
অপর এক যুবক তাকে সমর্থন করে বলল, ‘জানু মিয়াও আমাদের একই কথা বলেছেন।’
বাপুর অবস্থান সম্পর্কে সচেতন অপর একজন বলল, ‘এটাকে শুধু কুকুর বলে অসম্মান করা ঠিক হবে না। মনে রাখা দরকার এটা বাপুর কুকুর।’ বাপুর পাশাপাশি হেঁটে আসা কুকুরের পেছনে শত-শত উৎসাহী চোখ তাকে অনুসরণ করছে।
বাপু খাটে বসতেই কুকুরটিও হাত-পা গুটিয়ে তার পেছনে এলো। বাপু ‘সিলাউন’ (সিট ডাউন) জাতীয় কিছু একটা বলতে কুকুরটিও শান্ত হয়ে খাটে বসল।  লোকজন অবাক হয়ে গেল। কেউ ভাবল কুকুরটির নাম ‘সিলাউন’, অন্যরা ভাবল শব্দটা আসলে বসার আদেশ।
যে যা-ই হোক, সকলেই ততক্ষণ বুঝে গেছে, এই কুকুরটিকে বাপুর সেক্রেটারির চেয়ে বেশি সম্মান করতে হবে। এমনকি তার ছেলের চেয়েও বেশি সম্মান করতে হবে।
কেবল তিন বছর আগে জায়গিরদার যখন এখানে এসেছিলেন, এত স্বাধীনতা নিয়ে তার নিজের ছেলেও লাফিয়ে খাটে উঠতে পারেনি।
কুকুরটির নাম আসলে শিলু, সিলভার থেকে সংক্ষেপ করতে করতে শিলু। গ্রামবাসী সবাই ডাকতে শুরু করল শিলুভাই। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল যখন শুনল জায়গিরদার পাঁচশো টাকা দিয়ে কুকুরটিকে কিনেছেন। তারা বলাবলি করল, ‘এই টাকায় বাপুজি এক কুড়ি বলদ কিনতে পারত কিংবা পাঁচটা ঘোড়া।’ কেউ একজন বলল, ‘শিলুভাইর দাম তো হাতির দামের সমান।’ ‘এর যা ওজন, এই টাকায় সমান ওজনের রুপা কেনা যেত। ভাবো তো দেখি একবার।’ মন্তব্য করল অন্য কেউ একজন।
কিন্তু গ্রামের কুকুরগুলো তো আর সুবিবেচক নয়। রাস্তার নেড়ে কুকুর দেখলে এই কুকুরগুলো যেমন ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে, শিলুকে দেখে একই রকম ঘেউ-ঘেউ জুড়ে দিলো। শিলুও তীব্রস্বরে ঘেউ-ঘেউ করে জবাব দিলো। আর সবাই তখন ভয়ে কাঁপা শুরু করল। ‘হায় খোদা, এটা কেমন করে চিৎকার করে? মনে তো হচ্ছে একেবারে বাঘের গর্জন।’
গ্রামের এক যুবক প্রতিবাদ করল, ‘এসব বাজে প্যাচাল ছাড়ো। আমাদের গ্রামের কুকুরগুলোর সাথে এটাকে লড়তে দাও, দেখবে মুহূর্তের মধ্যেই এটাকে হারিয়ে দেবে। চেহারা দেখে কথা বলতে যেও না। আমাদের সবচেয়ে বাজে কুকুরগুলোও এটার চেয়ে ভালো।’
তার এই যুক্তিতে গ্রামবাসী মোটেও সন্তুষ্ট হলো না। বরং তারা মনে-মনে চাইল, বাপু তার কুকুরটিকে একবার ছেড়ে দিন, শিলু এসে গ্রামের ম্যাদামারা কুকুরগুলোকে তার শক্তি দেখিয়ে দিক। কেউ কেউ গিয়ে জানু মিয়াকে ধরল। বলল, ‘জানুভাই, শিলুভাইকে একবার ছেড়ে দাও না, অন্তত একবার ছেড়েই দেখ না – আমরা তো নিশ্চিত এই কুকুরগুলো সাথে সাথে ছুটে পালাবে। দারুণ মজা হবে।’
জায়গিরদার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আহম্মকের দল, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কী দেখছ? এইসব নেড়ি কুত্তাগুলোকে তাড়াচ্ছো না কেন?’ সাথে- সাথেই হাতে ইট-পাথর নিয়ে তারা কুকুরের পেছনে ছুটল।
কুকুরগুলো পালিয়ে গেল সত্যি, কিন্তু ঘেউ-ঘেউ থামল না, অন্য রাস্তা থেকে এদের ঘেউ-ঘেউয়ের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। কুকুরেরা মানুষের চেয়ে আরও বেশি মরিয়া হয়ে নিজের বাড়িঘর আঁকড়ে থাকে। ধাওয়াকারী গ্রামবাসী ফিরে আসতেই একই জায়গায় কুকুরদের আবার অভ্যুদয় ঘটল, এবার সাথে যোগ হয়েছে অন্য  রাস্তার আরও কুকুর।
১০ মিনিটের মধ্যেই পরিস্থিতি আবার উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠল। এবার মুখি জায়গিরদারের কাছে হাজির হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতার বাসনা ব্যক্ত করল। ‘বাপুজি, শিলুভাইকে একবার ছেড়েই দেন না। এই কুকুরগুলোর একটিও আশেপাশে কোথাও দাঁড়াবার সাহস পাবে না।’
গোঁফে পাক দিয়ে বাপু বললেন, ‘না-না, তা কী করে হয়? এটা একবার ক্ষেপে গেলে নিয়ন্ত্রণ করাই তো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখানে বেশ চুপচাপ আমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যান।’
মুখি বলল, ‘খাঁটি কথা বলেছেন – শিলুভাই তো খুবই সম্মানিত কুকুর।’ মুখে অবিবেচকের হাসি নিয়ে এক বুড়ো জিগ্যেস করলেন, ‘বাপুজি আপনার এই কুকুর কি বাঘের সাথে লড়াই করতে পারবে?’
অশালীনভাবে জায়গিরদারের কুকুরপ্রসঙ্গ উত্থাপনের বিষয়টি সংশোধন করার চেষ্টা করে অপর একজন বলল, ‘তার মানে আপনি শিলুভাইয়ের কথা বলতে চাচ্ছেন? শিলুভাইকে একবার দেখলেই তো সাধারণ চিতা দৌড়ে পালাবে।’
কিন্তু বুড়ো সহজে হারতে রাজি নন। বুড়ো বললেন, ‘বাপু, এটা কি ঠিক?’ উষ্ণ হাসি হেসে বাপু বললেন, ‘যাও একটা চিতা নিয়ে এসো, তারপর দেখি।’
আবার জায়গিরদারের দৃষ্টি পড়ল ঘেউ-ঘেউ করা কুকুরগুলোর ওপর। শিলুভাইও নিজের ক্ষমতা দেখাতে অস্থির হয়ে পড়ল। কিন্তু তার কী-ই বা করার  আছে? বাপুর সামনে তাকে তো ভদ্রই থাকতে হয়।
বাপু শিলুভাইর ঘাড় পেঁচিয়ে শিকল বাঁধলেন এবং যখন উঠে দাঁড়ালেন মুখি এক কাপ চা নিয়ে হাজির।
বাপু চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ মন পরিবর্তন করে হাত গুটিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি টেবিল জাতীয় কিছু একটা নেই?’
মুখি কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। টেবিল যে কী জিনিস সে বুঝে উঠতে পারল না। জায়গিরদারের রাজধানী শহরে যখন সে গিয়েছিল তখনকার একটা হোটেলের কথা তার মনে পড়ল। বিচলিত হয়ে বলল, ‘আপনি চেয়ারের কথা বলছেন, তাই না? ঠিক আছে…’
‘তুই একটা আস্ত আহাম্মক। চেয়ার দিয়ে কী করব? আমি চায়ের কাপটা রাখতে চাই।’
গ্রামবাসী সবাই দিশেহারা হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যেন হঠাৎ তারা আলোর নিশানা দেখতে পেয়ে টেবিলের খোঁজে দিগি¦দিক ছুটল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কী নিয়ে আসবে? একটা ঝুড়ি এনে উলটে বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এটা তো নিচুই থেকে যাবে। এ কাজের জন্য একটা বড় পাথর যে তুলে আনবে, তাও পেল না। পেলে তা কোনো না কোনোভাবে জায়গিরদারের জন্য নিয়ে আসত।
হঠাৎ সেই বুড়ো জ্ঞানগর্ভ একটি পরামর্শ নিয়ে এলেন। বললেন, ‘তোমরা কোনো জায়গা থেকে একটা ড্রাম তুলে আনছো না কেন?’
বৃদ্ধের এত বুদ্ধি দেখে মুখি হিংসেতে জ্বলে উঠল। একসময় সে নিজেকেই শোনালো, ‘এরকম একটা সাধারণ ব্যাপার আমার মাথায় খেলল না কেন? অথচ আমার নাকের তলাতেই ড্রাম দেখতে পাচ্ছি। যদি একজন মানুষ কাজটা করতে যেত তাহলে এক মিনিটেই ড্রাম নিয়ে হাজির হতো। কিন্তু এ কাজে তিনজন ছুটে যাওয়াতে দেরি হতে তো বাধ্য।’
কিন্তু মুখি যখন ড্রামের ওপর চায়ের কাপ রাখতে যাচ্ছে জায়গিরদার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোমরা কি সবাই গাধা না অন্য কিছু? আগে অন্তত ড্রামের ময়লাটা ঝাড়বে তো।’
কয়েকজন গ্রামবাসী উঠে দাঁড়িয়ে ড্রাম মুছতে শুরু করল; একজন যুবক তার কাপড় দিয়ে ড্রামের ধুলো ঝাড়তে শুরু করল। ধুলো কুকুরের গায়ে পড়ল এবং জায়গিরদার খুব বিরক্ত হলেন।
বুড়ো বললেন, ‘সাবধানে ধুলো ঝেড়ো, শিলুভাইয়ের গায়ে যেন না পড়ে।’ বাপুও বললেন, ‘আহাম্মক।’
অপর এক যুবক বলল, ‘আমি কি শিলুভাইকে পরিষ্কার করে দেব?’
পরিহাসের হাসি মুখে ধরে জায়গিরদার বললেন, ‘কেন? তোর কাপড়টা পরিষ্কার করতে?’
জনগণ আবার কিছুক্ষণের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লে বুড়ো তাদের এই অবস্থা থেকে রক্ষা করলেন। তিনি বললেন, ‘শিলুভাইর গা তো কাপড়ের চেয়ে পরিষ্কার।’
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। যুবক লজ্জা পেল এবং বিরক্ত হলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা বরফের মতো সাদা হতে পারে, তাই বলে এটা যে কুকুর তা তো আর বদলাচ্ছে না।’
অসহায় কণ্ঠে মুখি জিজ্ঞেস করল, ‘শিলুভাইর চা-টা আমি কী করব?’
কড়া স্বরে বাপু বললেন, ‘কেন, আর চা নেই?’
‘বাপুজি, চা তো তৈরিই আছে।’
বিলেত থেকে আনা সাদা মানুষের কুকুর কেমন করে চা খায় তা দেখার কৌতূহল সবার।
‘বেশ আমি তাহলে কাপটা ধরি, কেউ একজন গিয়ে আর একটা ড্রাম নিয়ে আসুক।’
বাপু আবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘গাধা কোথাকার! ড্রাম দিয়ে কাজ কী? ড্রাম তো আর চায়ের কাপ-পিরিচ থেকে চা খেতে যাচ্ছে না। আমার বদমাশ ভৃত্যগুলো কোথায়?’
ভেতরে ধূমায়িত চা-পানরত কজন ভৃত্য ও পুলিশ ভয় পেয়ে গেল। তবে তারা বেরিয়ে আসার আগেই যা কিছু বন্দোবস্ত করার হয়ে গেল।
শিলুভাইর জন্য মেঝেতে একটি বিছানা পেতে কাঁসার প্লেটে চা ঢেলে দেওয়া হলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে জনতা শিলুভাইকে নিয়ে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তারা মন্তব্য করল, ‘আমাদের কুকুরগুলোও তো একইভাবে পান করে।’
স্থানীয় কুকুরগুলো আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। পাহারাদাররা শিলুভাইর চা পান করা দেখায় ব্যস্ত, এই সুযোগে আবার কুকুরগুলোর অভ্যুদয় ঘটল এবং সাহস করে এবার কাছাকাছি চলে এলো।
জায়গিরদার বললেন, ‘আগে বসে চাটা শেষ করে তারপর যা খুশি তা-ই কর গিয়ে।’
নিজের কুকুরকে এই নির্দেশ দেওয়ায় গ্রামবাসীর উৎসাহ আবার বেড়ে যায়। গ্রামের কুকুর আর শিলুভাইর লড়াই দেখার আশায় তারা নিকটে দাঁড়ানো কুকুরগুলোকে তাড়ানোর প্রয়োজন বোধ  করল না।
শেষ পর্যন্ত বাপু তার কুকুর নিয়ে খোলা মাঠে এলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রামের চারদিক থেকে মানুষ এসে শিলুভাইর চারপাশে ভিড় জমালো। গলার শিকল রোদ্রালোকে রুপার মতো চকচক করে উঠল।
কুকুর নিয়ে ওত পেতে থাকা গ্রামবাসীকে বাপু সজোরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘গাধা, পথ থেকে সরে দাঁড়া। শিলু যাও।’
শিলু গোঁ-গোঁ করতে শুরু করল এবং ডোরাকাটা কুকুরের দিকে ছুটল, সেই কুকুর কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
‘পালাচ্ছিস কেন? সামনে আয়।’
ঠিক তখনই জায়গিরদারের চোখে পড়ল ডোরাকাটা উলটোদিকে ছুটে গিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে রইল। শিলু গোঁ-গোঁ শুরু করল কিন্তু ডোরাকাটা কুকুর অতটুকু ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাপুজি, একটু সাবধানে থাকবেন।’
কিন্তু ততক্ষণে একটি কালো কুকুর বাপুর পায়ে কামড় বসিয়ে দিয়ে ছুটে পালালো।
পরবর্তী উত্তেজনা ও হইচইয়ের মুহূর্তে একসময় শিলু বাপুর হাত থেকে ছুটে গেল। সবাই তখন উত্তেজিত। কেউ বাপুর পা পরীক্ষা করছে। পাশের সব কুকুর মিলে চারদিক থেকে শিলুকে আক্রমণ করেছে; অন্যরা শিলুভাইকে উদ্ধার করতে ছুটল। তারা শিলুর করুণ কান্না শুনতে পেল কিন্তু তাকে খুঁজে পেল না। তারা গ্রামের কুকুরগুলোকে লাঠি দিয়ে পেটাল; পাথর ছুড়ে মারল। কয়েকটি কুকুর ভীষণ জখম হলো, কতগুলো কুকুর যতদ্রুত সম্ভব পালিয়ে গেল। কিন্তু কোথাও শিলুকে দেখা পেল না। বাপু-চেঁচিয়ে বললেন, ‘গাধার দল আমার বন্দুক নিয়ে আয়।’
মানুষ তখন সতর্ক। কেউ একজন বন্দুক নিয়ে এলো।
তিনি চেঁচালেন, ‘গাধা, এটা নয়, অন্য বন্দুক নিয়ে আয়।’
অন্য বন্দুক আনার আগেই গ্রামবাসী শ্বাসরোধ করে মারা বেশ কটি কুকুর সামনে এনে হাজির করল।
বাপু অসহায়ের মতো এই দৃশ্যটিতে চোখ রাখলেন। রক্তে ডুবে থাকা শিলু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, জীবিত কয়েকটি কুকুর পালিয়ে গেছে। শিলুর নীল চোখ বাপুর বন্দুকের চেয়েও ভয়াবহ দেখাচ্ছে। আর তার চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক ছিল ভয়াবহ নীরবতা এবং মৃত্যু-উন্মুখ কুকুরের যন্ত্রণার কান্না। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য অনেকেই সহ্য করতে পারছিল না, তারা বাড়ি চলে গেল। এমনকি বাপুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনও দৃশ্যপট থেকে বিলীন হতে শুরু করল। কিন্তু কেউ কেউ এতোই আতঙ্কিত যে পা-ও নাড়াতে পারছিল না।
বাপু আর একবার চিৎকার করে বললেন, ‘গাধা! দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? যা, অলিগলির যত কুকুর ধরে নিয়ে আয়। এদিকে কোনো মানুষ যেন না আসে। আমার এই সতর্কবার্তার পর যদি কেউ এসে আমার বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা যায় আমি তার জন্য দায়ী থাকব না।’
সবাই ভাবলো এখন সরে যাওয়াই নিরাপদ। কয়েক মিনিটের মধ্যে জায়গাটা জনশূন্য হয়ে গেল। থাকলেন কেবল জায়গিরদার।
প্রায় সবাই নিজেদের যার-যার বাড়িতে আটকে রাখে। যারা জায়গিরদারের ভৃত্য ও পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পায়নি, তারা কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের কাছ থেকে গ্রামের কুকুরগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। আসলে জায়গিরদারের ভৃত্যরাও চায় না কুকুরগুলোর মৃত্যু হোক। কিন্তু যেহেতু জায়গিরদারকে শান্ত করতে কুকুর ধরার কোনো বিকল্প নেই, অনিচ্ছাতেই তাদের এ-কাজে নামতে হয়। তারা গ্রামবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করে, অন্তত কয়েকটা কুকুর ধরে দাও। তাতে গ্রামটা ঝামেলা থেকে রক্ষা পাবে।
প্রায় ১০টা কুকুরকে ঘিরে ধরলেও বন্দুক নিয়ে অপেক্ষমাণ বাপুর কাছে এর অর্ধেক কুকুর নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। বাপু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাঁচটা কুকুরকে গুলি করে হত্যা করেন। তারপর চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আর সব কুকুর কোথায়?’
কেউ জবাব দেওয়ার সাহস পেল না। জানু মিয়া তার সকল সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘আমরা আর খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে।’
‘বাজে বকছো কেন? বদমাশগুলো নিশ্চয়ই কুকুরগুলোকে নিজেদের বাড়িতে লুকিয়ে ফেলেছে। যাও, আবার গিয়ে বাড়ি-বাড়ি খোঁজ করো। কোনো বাড়িতে কুকুর পেলে সে বাড়ির মালিকসুদ্ধ বেঁধে নিয়ে আসবে।’
আদেশ পেয়ে ভৃত্যরা আবার বেরিয়ে গেল।
কিন্তু জায়গিরদার আবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘থাক জানু, তোরা কোনো কাজেরই না। বরং একটা কাপড়ে শিলুকে পেঁচিয়ে গাড়িতে এনে তোল।’
যে যুবকের ঘাড়ের কাপড় এক ঘণ্টা আগেও জীবন্ত শিলুকে মোছার প্রশ্নে অত্যন্ত নোংরা বিবেচিত হয়েছে জানু মিয়া তার সেই কাপড়টি ছাড়া কুকুরের জন্য কারো কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় উদ্ধার করতে পারল না।
যুবক ভাবল, ‘হায় খোদা! আমি কী এমন অপরাধ করেছি যে আমার ঘাড়ের কাপড়টিও নিয়ে নিচ্ছে।’ এমনকি গ্রামের পথে ধূলি উড়িয়ে বাপুর গাড়ি যখন চলে যায়, তখনও তার একই প্রশ্ন। গ্রামের সবাই জানে কুকুরের যে দাম ভাগাভাগি করে তাদের সবাইকে তা পরিশোধ করতে হবে। তবে এরই সঙ্গে তারা একটি দুশ্চিন্তা থেকেও মুক্তি পেল। জায়গিরদার চলে যাওয়ার পর তাদের পাণ্ডুর মুখমণ্ডল আরেকবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন স্বাভাবিক হয়ে এলো। আধঘণ্টার মধ্যে জায়গিরদারের সকল সফরসঙ্গী গ্রাম ত্যাগ করল।
রাস্তাঘাট জনশূন্য। মৃত কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহ ভয়াবহ দেখাচ্ছে। সর্বত্রই নীরবতা। ব্যতিক্রম শুধু কাকের ডানা ঝাপটার শব্দ, মৃত্যু-উন্মুখ কুকুরের গোঙানি – এসব ভয়াবহতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। গ্রামে তখন যে নীরবতা বিরাজ করছে তা অদ্ভুত, ত্রাস সঞ্চারক ও নিষ্পেষক – এ যেন মৃত্যুর নীরবতা, যাকে স্পর্শ করে, তাকেই ধ্বংস করে ফেলে।
ততক্ষণে ভাঙ্গি গ্রামে এসে পৌঁছেছে, প্রেতাত্মার মতো সে কবরে-কবরে ঘুরে বেড়াচ্ছে; নির্বিকারভাবে যখন পাইপ টেনে যাচ্ছে, কুকুরগুলোর মৃত্যুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

----------------

লেখক পরিচিতি :
গুজরাটি কথাসাহিত্যিক পান্নালাল নানালাল প্যাটেল (৭ মে ১৯১২-৬ এপ্রিল ১৯৮৯)। ভারতে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে। তাঁর জন্ম রাজস্থানের একটি গ্রামে। গ্রামের নাম মান্দলি। পান্নালাল ১৯৮৫ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে : ফকিরো, লাভুন লোহি, মানকাভতার, নগদ নারায়ণ, আল্লাদ জাকড়ি, এক আনোখি প্রীত, কচ-দেবযানী, লোকগুঞ্জন, মালেলা জিভ, মানাভিনি ভাবে ইত্যাদি।
বিখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক উমাশঙ্কর যোশী মনে করেন, পান্নালাল শেক্সপিয়রের চেয়ে কম নন। দারিদ্র্য তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কৃষিমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত লেখক নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। ৬ এপ্রিল ১৯৮৯ সালে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে পান্নালাল প্যাটেলের মৃত্যু হয়। জন্মশতবর্ষে পান্নালাল প্যাটেলের একটি গল্প ‘দ্য জায়গিরদার অ্যান্ড হিজ ডগ’ বাংলায় ভাষান্তরের মাধ্যমে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

No comments

Powered by Blogger.