দেশলাইয়ের দেশে সিনেমা

কেমন লাগত যদি দেশলাইয়ের কাঠি ধরাতে গিয়ে হঠাত্‌ই বাক্সে দেখতেন অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, করিনা কপূর বা প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ছবি!
কেমন লাগত যদি দেশলাইয়ের কাঠি ধরাতে গিয়ে হঠাত্‌ই বাক্সে দেখতেন অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, করিনা কপূর বা প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ছবি! চমকে উঠবেন না, এটি কল্পনা নয়, বরং বাস্তব সত্যি! জনপ্রিয় বহু সিনেমা তারকার ছবি দেওয়া অজস্র দেশলাই বাক্স এই কলকাতা থেকেই অনেক বছর ধরে সংগ্রহ করেছি আমি। খুব কম ক্ষেত্রেই বেঁচে থাকাকালীন বিখ্যাত মানুষদের ডাকটিকিট বেরিয়েছে, কিন্তু দেশলাই বাক্সে তার উলটোটাই ঘটে। বিজ্ঞাপন জগতের ক্ষেত্রে দেশলাই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কারণ কম খরচে বহুসংখ্যক মানুষের কাছে এর মাধ্যমে নানা বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। আবার দেশলাইয়ের বাক্সে আকর্ষণীয় বিষয় থাকলে সাধারণে আগ্রহী হয়ে তা কিনতে পারেন বলেও ধারণা।
৪২ বছর ধরে আমার সংগৃহীত কমবেশি ৩০,০০০ দেশলাই বাক্সের মধ্যে সবথেকে পুরনো যে সিনেমার মার্কা আছে তা হল জয়রাজ শাকিলা অভিনীত ‘হাতিম তাই’-য়ের (১৯৫৬ সাল)। নার্গিস অভিনীত ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ১৯৫৭-তে তুমুল জনপ্রিয় হয়। নার্গিসের সেই বিশেষ ভঙ্গিমার ছবি এই সেদিন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বাক্সে ছাপা হয়েছে। দিলীপকুমারের অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ ‘রাম অউর শ্যাম’ (১৯৬৭) নামাঙ্কিত দেশলাইয়ের বাক্সে তাঁর, ওয়াহিদা রহমান আর মুমতাজ়ের ছবি ছিল। হিন্দি সিনেমার প্রবাদপুরুষ রাজ কাপুর নির্মিত ‘মেরা নাম জোকার’ বক্স অফিস অতটা হিট না হলেও দেশলাইয়ে সুপারহিট হয় কারণ ওই সময় ওই নামে অনেক মার্কা বাজারে প্রচুর বিক্রি হয়।
এঁদের পরবর্তীযুগে ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্নার মতো সুপারস্টারদের নিয়ে কয়েকটি মার্কা বেরিয়েছে। হিন্দি সিনেমার প্রথম ব্লকব্লাস্টার ছবি বললেই ‘শোলে’র কথা মনে পড়বে (১৯৭৫)। শোলের বাসন্তীরূপী হেমামালিনী ও বীরুরূপী ধর্মেন্দ্রকে একাধিক মার্কায় একসঙ্গে দেখা গেছে। শোলের কিছু আগে ফিল্মি দুনিয়ার প্রথম মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনের জয়যাত্রার সূচনা হয়। তাঁর পরপর সুপারহিট সিনেমার প্রতিফলন দেশলাইয়ের দেশে পড়ে এবং এক নাগাড়ে বহু বছর ধরে তাঁর একার ছবি বা কখনও কখনও তাঁর নায়িকাদের সঙ্গে তাঁর ছবি (রেখা, হেমা মালিনী প্রমুখ) বেরতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঢেউ এখন স্তিমিত। পরে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হন ‘কৌন বনেগা করোড়পতি’ সঞ্চালনা করে। নতুন করে তাঁর ছবি দেশলাইয়ে বেরোতে থাকে। এ যাবত্‌ অমিতাভ বচ্চনের সবচেয়ে বেশি ৫০টি ছবি পেয়েছি। তাঁর অভিনীত বেশ কয়েকটি সিনেমা যেমন ‘কুলি’, ‘মর্দ’, ‘দোস্তানা’ ইত্যাদি বাক্সে দেখা যায়। নির্দ্বিধায় বলা যায় এখানেও জনপ্রিয়তম মেগাস্টার তিনিই।

বাঙালিদের পক্ষে বিশেষ গর্বের বিষয়, বলিউডে ‘মৃগয়া’ দিয়ে যাঁর যাত্রা শুরু সেই মিঠুন চক্রবর্তী আমার সংগ্রহ দ্বিতীয় স্থানে আছেন। তাঁর ছবি দেওয়া বাক্সের সংখ্যা ২৮। বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তমকুমারকে নিয়ে চারটি দেশলাই বাক্স পেয়েছি যেখানে তিনি নানা নামে ভূষিত হয়েছেন। শোনা গেলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের উপর দেশলাই জোগাড় করতে পারিনি। কিন্তু তাঁর কন্যা মুনমুন সেন স্বনামে উপস্থিত আছেন।
সত্তরের দশকের ‘ড্রিম গার্ল’ হেমা মালিনীর উপরেও এক ডজন দেশলাই পেয়েছি। এরপর চলচ্চিত্র আকাশে শ্রীদেবী আর্বিভূত হন এবং ‘চাঁদনী’ সুপারহিট হওয়াতে ওই নাম-সহ বেশ কিছু বাক্সে তিনিও উপস্থিত। দক্ষিণ ভারতীয় আর এক জনপ্রিয় নায়িকা জয়া প্রদাকেও নিয়েও বেশ কিছু মার্কা আছে। ‘তেজ়াব’, ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ইত্যাদি সুপারহিট ছবির নায়িকা মাধুরী দীক্ষিতও সসম্মানে উপস্থিত আছেন। এছাড়া রেখা, জ়িনত আমন, মীনাক্ষি শেষাদ্রি, পুনম ধীলোঁ প্রমুখ বহু নায়িকার ছবি পাওয়া গেছে। আবার ইদানিং কালের নায়িকাদের মধ্যে রবিনা ট্যান্ডন, মনীষা কৈরালা, ঐশ্বর্য রাই, রানি মুখোপাধ্যায়, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, করিনা কপূরদের ছবিও কিছুদিন আগেই বেরিয়েছে।
অন্যদিকে নায়কদের মধ্যে সুনীল দত্ত, জিতেন্দ্র, বিনোদ খান্না, কমল হাসান, অনিল কপূর, ঋষি কপূর, সঞ্জয় দত্ত, সানি দেওলরা বিভিন্ন সময়ে দেশলাইয়ের ছবিতে জায়গা পেয়েছেন। সুবিখ্যাত ভিলেন ‘প্রাণ’ ও শোলের ‘গব্বর সিং’ আমজাদ খানও আছেন। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা স্টার এম.জি. রামচন্দ্রন, শিবাজী গণেশন, প্রভুদেবা, নার্গাজুনও আছেন। বলা বাহুল্য যে অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকা রজনীকান্ত বহু দেশলাইয়ে নানা ভঙ্গিতে উপস্থিত আছেন। ২০০০-এ ‘কহো না প্যার হ্যায়’ বক্স অফিসে হই হই ফেলে দেয় এবং স্টার হিসেবে হৃত্বিক রোশন দেশলাইয়ের ছবিতে বিশেষ স্থান পান। ‘গদর’ ছবির বিজ্ঞাপনি বাক্সে সানি দেওল ও অমিশা পটেলের ছবি একসঙ্গে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। অক্ষয় কুমারকে একইভাবে ‘খিলাড়ি’ ছবির বাক্সে দেখা গেছে (১৯৯২)। আমির খান ও মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত ‘দিল’ (১৯৯০) বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ায় বেশ কিছু বাক্সে এঁদের দু’জনের ছবি একসঙ্গে ছাপা হয়েছে। ‘সাজন’ (১৯৯১) সুপারহিট হওয়ায় সলমন খান ও মাধুরী দীক্ষিতের ছবি ছাপা হয়। শাহরুখ খান এসেছেন তাঁর অসামান্য অভিনয় সমৃদ্ধ ‘বাজ়িগর’ ছবির জন্য। মনে রাখা দরকার এই তালিকাগুলি আংশিক মাত্র।

গানবহুল বাংলা সিনেমা ‘অজস্র ধন্যবাদ’ ১৯৭৭-এ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। মনে পড়ে, ভারতী সিনেমা হলেও বাইরে থেকে ওই সিনেমা বিজ্ঞাপনের বাংলায় লেখা বাক্স কিনেছিলাম (যা এখন অত্যন্ত বিরল), যেটিতে শৈলেন্দ্র সিংহের ছবির পাশে অভিনেত্রী অপর্ণা সেন ও পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের নাম ছিল।
ভারতীয় সিনেমা জগত্‌কে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন সেই সুমহান পরিচালক সত্যজিত্‌ রায় তাঁর সারাজীবনের অবদানের জন্য অস্কার পেয়েছিলেন। একটি দেশলাই বাক্সে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে তাঁর ছবির পাশে অস্কার পুরস্কারের রেপ্লিকা রেখে। তেমনই আর এক বিশ্ববিশ্রুত পরিচালক-অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে ভারতীয় দেশলাই শিল্প সম্মান জানিয়েছে কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে যাতে তাঁর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত টুপি ও লাঠিরও ছবি আছে। ব্রুস লি জনপ্রিয়তার বিচারে বিশেষ স্থান পেয়েছেন।
এবার একটু বিদেশি দেশলাইয়ের খোঁজ নেওয়া যাক। বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, গ্রেটা গার্বো প্রমুখ অভিনেত্রী বিদেশি দেশলাইয়ের বাক্সে উপস্থিত আছেন। টাইটানিক-খ্যাত লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও অতি সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে একটি বিদেশি বাক্সও পেয়েছি।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে দেশলাইয়ের দেশে সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক সবাই বিশেষ স্থান পেয়েছেন। তবে ছবি জোগাড় করার অসুবিধে হল যে ছোটবড় অজস্র কোম্পানির দেশলাই ভারতের নানা জায়গা বিশেষত দক্ষিণভারত থেকে বেরোচ্ছে আবার উঠেও যাচ্ছে। এর জন্য তাই চোখ খোলা রেখে খোঁজখবর নিতে হয়। হঠাত্‌ যদি এরকম আকর্ষণীয় ছবির দেশলাই বাক্স পাওয়া যায় তখন সংগ্রাহকের মন যে আনন্দে ভরে ওঠে তার তুলনা কোথায়?

No comments

Powered by Blogger.