ডাচ নৌবাহিনী থেকে পালাতে বিমান চুরি করেছিলেন যিনি

নববিবাহিত স্ত্রীর সাথে দেখা করতে ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ বিমানঘাঁটি থেকে বিমান চুরি করে পালাতে গিয়ে নিখোঁজ হন মার্কিন অফিসার সার্জেন্ট পল মেয়ের। তার উপরে গত দু'বছর অনুসন্ধান করছেন বিবিসি'র সাংবাদিক এমা জেন কিরবি।
প্রায় একই রকম কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন ডাচ নৌবাহিনীর তরুণ থিও ফন এইজ্ক। তবে, মি. মেয়েরের সাথে এইজ্কের ফারাক হচ্ছে, নিজের কাহিনী নিজ মুখে বলার জন্য তিনি এখনো বেঁচে রয়েছেন।
থিও ফন এইজ্কের ছোট্ট বাড়িটি যেন একটা আশ্চর্য খনি। ঝাড়ুর ওপর বসে থাকা খেলনার ডাইনি থেকে শুরু করে ওপরের তাকে রাখা চীনামাটির বিড়াল পরিবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। পাশেই কয়েকটা খুলি দাঁত কেলিয়ে আছে।— কী নেই সেখানে!
তবে, এইজ্কের বাসার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু ওই কফি টেবিলটা— যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সযত্নে রাখা পুরনো পত্রিকার কিছু ক্লিপিং।
নিজের নব-তারুণ্যের দিনগুলোতে থিও ফন এইজ্ক সবসময় উড়ার স্বপ্ন দেখতেন
১৯৬৪ সালের সেসব পত্রিকার শিরোনামে লেখা রয়েছে এক তরুণ নাবিকের কথা — যে কিনা উড়োজাহাজ চুরি করে মাল্টা থেকে লিবিয়ার বেনগাজীতে পালিয়ে এসেছিল।
বয়সের ভারে সব চুল সাদা হয়ে যাওয়া ফন এইজ্ক পত্রিকার সেই সব ছবির দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বলভাবে বলেন, "এটা আমি! ছবির ওই আমিটার বয়স তখন মোটে ২১"!
তার স্ত্রীও পাশে থেকে এসব কথা-বার্তা শুনছিলেন আর মাঝে-মাঝে কৌতুক ভরে অংশও নিচ্ছিলেন আলাপে।
তার দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, "কি বেয়াড়া রে বাবা! ভালো যে তোমার সাথে তখন পরিচয় হয়নি আমার।"
নিজের নব-তারুণ্যের দিনগুলোতে থিও ফন এইজ্ক সবসময় উড়ার স্বপ্ন দেখতেন। সত্যি বলতে সেই সাত বছর বয়স থেকেই তার ছিল উড়বার সাধ।
কিন্তু বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে পাইলট হবার মতন ভালো রেজাল্ট তার ছিল না।
তখন হঠাৎ একদিন সে জানতে পেলো, ডাচ নৌবাহিনীতে নবিশ হিসেবে ইলেক্ট্রিশিয়ান পদে লোক নিচ্ছে। প্রশিক্ষণার্থীরা এখানে ভালো করতে পারলে তারা বৈমানিকের প্রশিক্ষণ পাবে।
থিও ফন এইজ্কের সাম্প্রতিক ছবি
ব্যাস! বৈমানিকের প্রশিক্ষণ পাবার সুযোগ আছে জেনেই নৌবাহিনীর ইলেকট্রিক-মিস্ত্রির তালিকায় নাম লিখিয়ে নিলেন ১৯ বছর বয়সী এইজ্ক। চুক্তি ছিল পরবর্তী ৮ বছর সে নৌবাহিনীতেই থাকবে।
তিনি প্রশিক্ষণে ভালো করেন। বৈমানিকের ট্রেনিং পাবার জন্যও মনোনীত হন। সেসময় ১৯৬৪ সালের শুরুর দিকেই, তার লগবুকে যোগ হয়েছে ৪০ ঘণ্টা উড়ার খতিয়ান।
এমন সময় একদিন এক পার্টিতে তার কমান্ডিং অফিসার বিমানের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের অনুভূতি ও মতামত জানাতে বলেন।
এইজ্ক তখন রাখঢাক না রেখে বলেছিলেন যে, প্রশিক্ষণের জন্য ছোটো-ছোট বিমান না দিয়ে সাবমেরিন বিধ্বংস গ্রুমান ট্র্যাকার বিমানে করে প্রশিক্ষণ দিলে আরও ভালো হয়।
কিন্তু ঠিক এর পরদিনই এইজ্কের বিপত্তির শুরু। হঠাৎ করেই তার রেজাল্ট কার্ডে কমলা রঙের দাগ দেয়া হল। এর অর্থ হচ্ছে, তার রেজাল্ট এতই খারাপ যে, ফেল করার আশঙ্কা রয়েছে।
এটা দেখে সে ক্ষেপে গেলো। শিক্ষক আসার আগেই ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে ট্রেনিং নিয়ে কড়া মন্তব্য লিখে রাখল।
এর শাস্তি হিসেবে তাকে সপ্তাহান্তের জন্য নিজস্ব জেলে পুরে দিলো নৌবাহিনী। কিন্তু সুযোগ বুঝে সে জেল থেকে পালাল।
বেনগাজিতে এইজ্কের একক ভ্রমনের তথ্য রয়েছে লগ বুকে
পালানোর পর তাকে বৈমানিকের প্রশিক্ষণ থেকে বহিষ্কার করা হল।
কিন্তু এইজ্ক দমে গেলেন না। তাকে যেন বৈমানিকের প্রশিক্ষণে আবারো ফিরিয়ে নেয়া হয় সেই লক্ষ্যে আবেদন-নিবেদন করতে লাগলেন।
এই নিয়ে অফিসে আবেদন করতে গেলে অসাবধানে তাকে ভুল কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ছিল।
কয়েকমাস পর অফিস থেকে বলা হল, ভুল পদ্ধতিতে আবেদন করায় তার অনুরোধ বিবেচনা হয়নি। ততদিনে অনেক সময় চলে গেছে। তাই, পুনরায় আবেদনের সুযোগও নেই।
অথচ চুক্তি মোতাবেক নৌবাহিনীতে তখনো তার আরও ছয় বছর বাকি। এই পুরোটা সময় তাকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রী হয়েই কাটাতে হবে।
কিন্তু এভাবে এইজ্ক চাকরিতে থাকবেন না। তাই, চাকরি থেকে অব্যাহতি চাইলেন। কিন্তু বিধি বাম! তাকে অব্যাহতি দেয়া হল না। বারংবার অব্যাহতির আবেদন করলেও প্রতিবারই তিনি প্রত্যাখ্যাত হলেন।
তার সাথে যা করা হয়েছে সেটি মোটেও ন্যায়সঙ্গত হয়নি বলেই মনে করতেন এইজ্ক। তাই, এই নিয়ে এইজ্ক ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং নৌবাহিনী থেকে পালাবার ফন্দি আঁটতে শুরু করেন।
বিমান চুরি করে পালাতে গিয়ে নিখোঁজ হন মার্কিন অফিসার সার্জেন্ট পল মেয়ের
পালানোর একমাত্র রাস্তা হিসেবে এইজ্ক দেখলেন, গ্রুমান ট্র্যাকার প্লেন। কিন্তু সেটাতে তিনি তখনো কোনোদিন চড়েননি। তবে, এইজ্ক দমে যাবার পাত্র নন।
গ্রুমান ট্র্যাকার প্লেনের হ্যান্ডবুক নিয়ে সকাল-বিকাল পড়তে লাগলেন। তার অন্য সহকর্মীরা যখন পার্টিতে যায় অথবা বিশ্রাম নেয় এইজ্ক তখন পড়েন। পড়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করেন গ্রুমান ট্র্যাকার প্লেনের নাড়ী-নক্ষত্র।
একদিকে, এইজ্ক হ্যান্ডবুক পড়েন। অন্যদিকে, গ্রুমান ট্রেকার প্লেনের অভিজ্ঞ পাইলটদের সাথে আলাপের ছলে জেনে নেন, কিভাবে ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়া হয়, কিভাবে বিমান অবতরণ করা হয় সেইসব বৃত্তান্ত।
কিন্তু এইজ্কের মনে একটা সন্দেহ ছিল। সেটি হচ্ছে, সে যেখানে আছে সেখান থেকে উড়ে গন্তব্যে পৌঁছানো মুস্কিল।
একটু হলেই হয়তো গিয়ে ঠেকতে হবে রাজনৈতিক বিবাদে ভরা তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে।
এমন সময়, একদিন, থিও ফন এইজ্কের সামনে যেন সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে গেলো। হঠাৎ তখন ব্রিটিশ আর্মির সাথে মাল্টায় দুই মাসের একটা অনুশীলনের সুযোগ এলো।
গ্রুমান ট্র্যাকার
সুযোগ বুঝে, স্বেচ্ছাসেবীদের দলে ঢুকে গেলেন এইজ্ক। কেননা, তিনি ভেবে দেখলেন, মাল্টা থেকে বিমান নিয়ে পালানো সহজ।
মাল্টায় অনুশীলনে গিয়েও তিনি নিয়মিত পড়তে থাকলেন বিমানের হ্যান্ডবুক। পড়তে পড়তে প্রায় আত্মস্থ করে নিলেন খুঁটি-নাটি। পাশাপাশি, বিমানের মেকানিক্স বা মিস্ত্রীদের কাজ-কর্ম খুব চৌকসভাবে লক্ষ্য করতে থাকলেন।
অবশেষে, অনুশীলন শেষ হল। যে যার ঘাঁটিতে ফিরে যাবার আগে এক সন্ধ্যায় হল বিদায়ী অনুষ্ঠান। সেখানে সবাই প্রচুর পানাহার করলেও এইজ্ক রইলেন শান্ত। কেননা ঠিক পরদিন ভোরেই তিনি পালাবেন।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ধার করে একটা সাইকেল নিয়ে এইজ্ক রানওয়েতে এলেন। এইজ্ক বলছিলেন, "পালাতে যাবার সময় সার্জেন্ট মেয়ের গার্ডকে নিজের নাম বলেছিলেন ক্যাপ্টেন এপস্টেইন। আর আমি প্রহরীকে বললাম, আমার নাম জানসেন। আমার সম্পর্কে প্রহরীর কোনও ধারণাই ছিল না। সে আমাকে বিমানের হ্যাঙ্গারের দরজা খুলতে সাহায্য করলো।"
ডয়েচ সংবাদপত্রে থিও ফন এইজ্কের এই কাণ্ড নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল
অতি নিখুঁতভাবে চুরির পরিকল্পনা এঁটেছিলেন এইজ্ক। প্রহরীর পিস্তল ও সাইকেল তালা মেরে রেখেছিলেন। তার অফিসের টেলিফোনের সাথে যে মাইক্রোফোন ছিল, সেটিকেও সরিয়ে রেখেছিলেন।
সেই রোমাঞ্চকর দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে এইজ্ক বলছিলেন, "তো আমি ইঞ্জিন চালু করলাম। রেডিও অন করলাম। আমার নাম কী? আমি কী করছি— ইত্যাদি কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জানতে চাইছিল। কিন্তু আমি কোনও উত্তরই দিইনি। আমি উড়াল দিলাম।"
ডাচ নৌবাহিনীর সেই গ্রুমান ট্র্যাকার সাবমেরিন বিধ্বংসী বিমানে তখন দুইটি টর্পেডো ছিল। টর্পেডোগুলো নিয়ে তিনি মোটেই ভাবছিলেন না। কারণ তিনি শুধু ভাবছিলেন, "নৌবাহিনীতে আমি আর কিছুতেই ফিরে যাবো না"।
এইজ্ক বলছিলেন, "ভূমধ্যসাগরের বুক ৫ হাজার ফিট উপর দিয়ে আমি উড়ছিলাম। আমি বুঝতে পারি, কেমন ছিল সার্জেন্ট মেয়েরের অনুভূতি!"
পালানোর সময়ে ককপিটে সার্জেন্ট মেয়ের তার নব বিবাহিতা স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। তিনি নিজের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করছিলেন।
অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর আগে এইজ্ক ককপিট থেকে কাউকে ফোন করেননি। কিন্তু তার বেশ কিছুদিন আগেই তিনি তার মাকে রূপোর একটা ক্রস উপহার পাঠিয়েছিলেন।
নেদারল্যান্ডসে ফেরার পর থিও ফন এইজ্ক।
এইজ্ক বলছিলেন, "এটা দেখে মা নিশ্চয়ই অনুমান করেছিলেন যে, আমি কিছু একটা করতে যাচ্ছি।"
সেদিন সাড়ে ৫ ঘণ্টা উড়লেন ২১ বছর বয়সী থিও ফন এইজ্ক। অবতরণ করলেন বেনগাজিতে। মিলিটারি বিমান দেখে যে ব্যক্তিটি প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন সৌভাগ্যক্রমে সে ছিল ডাচ প্রবাসী। তার কাছে নিজের পুরো কাহিনী বললেন এইজ্ক।
ইউরোপে ফিরে গেলে নিশ্চিত জেল। তাই স্বদেশী সেই ডাচ ব্যক্তির পরামর্শে লিবিয়ার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এইজ্ক। স্বদেশী সেই ডাচ ব্যক্তির পরামর্শে লিবিয়ার পুলিশের কাছে এইজ্ক এটাও বললেন যে, সে ইউরোপের উদার যৌন আচরণ ও সমকামিতার বিরোধী। ফলে, এইজ্ক রাজনৈতিক আশ্রয় ও সুরক্ষা পেলো।
অবশেষে, ডাচ রাষ্ট্রদূতের সাথে অনেক আলাপ-আলোচনা ও দেন-দরবারের পর এই সিদ্ধান্ত হল যে, নেদারল্যান্ডেই ফিরে যাবেন এইজ্ক। তবে ছল করে পালিয়ে আসার কারণে তাকে সেদেশে মাত্র ১২ মাস জেল খাটতে হবে। এর বিনিময়ে নৌবাহিনী থেকে সে পাবে সম্মানজনক প্রস্থান।
থিও ফন এইজ্ক বলছিলেন, "আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি। আমি নৌবাহিনী থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম, পেয়েছি। এবং যা করেছি তার জন্য আমার কোনও অনুতাপ নেই।"

No comments

Powered by Blogger.