আফগানিস্তানে দখলদারিত্বের অবসান!

ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তান সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা লেখা হচ্ছে। এই আজেবাজে কথাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সত্য গোপন করা হচ্ছে ।প্রথমত, তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করেছে। দ্বিতীয়ত, তালেবানরা জিতেছে কারণ তাদের জনসমর্থন বেশি। তৃতীয়ত, এর কারণ এই নয় যে, অধিকাংশ আফগান তালেবানকে ভালোবাসে। কারণ আমেরিকার কর্তৃত্ব তাদের কাছে  অসহনীয়। চতুর্থত, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবেও পরাজিত হয়েছে। বেশিরভাগ আমেরিকান এখন আফগানিস্তান ত্যাগের পক্ষে এবং যে কোনো বিদেশী যুদ্ধের বিপক্ষে। পঞ্চম, এটি বিশ্ব ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি একটি ছোট, দরিদ্র দেশের মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে। এটি সারা বিশ্বে আমেরিকান সাম্রাজ্যের শক্তিকে দুর্বল করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট । ষষ্ঠত, নিজেদের জীবনকে বাঁচাতে কট্টর নারীবাদে বিশ্বাসী অনেক মহিলা তালেবানদের বিপক্ষে যেতে পারেননি , যা নারীবাদের প্রতি এক প্রবল ধাক্কার সমান।  ন্যান্সি লিন্ডিসফার্ন এবং জোনাথন নিল জানাচ্ছেন এগুলি শুধু কয়েকটি কারণ তারা বর্ণনা করেছেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আফগানিস্তানের নৃতত্ত্ববিদ হিসাবে ফিল্ডওয়ার্ক করার সময় তাঁরা লিঙ্গ বৈষম্য , রাজনীতি এবং যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন।

একটি সামরিক জয়
এটি তালেবানদের জন্য একটি সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয়।  কমপক্ষে দুই বছর ধরে আফগান বাহিনী - দেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশে কর্মরত  অনেককে হত্যা এবং মারাত্মকভাবে জখম করেছে যাতে তারা মাথা  তুলে দাঁড়াতে না পারে।  গত দশ বছর ধরে তালেবানরা অধিক সংখ্যক গ্রাম এবং কিছু শহরের ওপর নিজেদের  নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে । ধীরে ধীরে একটির পর একটি শহর-গ্রাম  দখল করতে করতে শেষে তারা রাজধানী কাবুলে থাবা বসায়।  গুরুত্বপূর্ণভাবে, উত্তর জুড়ে তালেবানরা ক্রমাগত তাজিক, উজবেক এবং আরবদের নিয়োগ করছিল। এটি তালেবানের জন্য একটি রাজনৈতিক বিজয়ও বটে । পৃথিবীতে কোন গেরিলা বিদ্রোহ জনপ্রিয় সমর্থন ছাড়া এই ধরনের বিজয় অর্জন করতে পারে না। এককথায়  বলা যেতে পারে , আফগান জনগণ আমেরিকান দখলদারদের চেয়ে তালেবানদের পাশে দাঁড়ানো শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছে । আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের চেয়ে অনেক আফগানরাই  তালেবানদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেছে।  শেবার্গানে দোসতাম এবং হেরাটে  ইসমাইল খানের পরাজয় তার জ্বলন্ত  প্রমাণ। ২০০১ সালের তালেবানরা অপ্রতিরোধ্যভাবে পুশতুন সম্প্রদায়ের ছিল এবং তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিল। ২০২১ সালে বহু জাতিগোষ্ঠীর তালেবান যোদ্ধারা উজবেক এবং তাজিক অধ্যুষিত এলাকায় ক্ষমতা দখল করেছে।গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম হলো মধ্য পার্বত্য অঞ্চলে হাজারা অধ্যুষিত এলাকা। সব আফগানই অবশ্য তালেবানদের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাদের প্রতিবাদ আসলে বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে , যাকে গৃহযুদ্ধও বলা যেতে পারে । বেঁচে থাকার জন্য অনেক আফগানই  আমেরিকান, সরকার বা যুদ্ধবাজদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে উভয় পক্ষের সাথে সমঝোতা করেছেন এবং বাকিদের অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন না যে কোন পক্ষ নেবেন, তারা সময়ের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন।আমেরিকার বাইডেন সরকারের ওপর পুরো দোষ চাপিয়ে লাভ নেই , যদি আমেরিকান সৈন্যরা আফগানিস্তানে থেকে যেত, তাহলে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হতো অথবা মরতে হতো। এটি বর্তমান পরাজয়ের চেয়ে আমেরিকান শক্তির জন্য আরও বড় অপমান হতো । বাইডেনের মতো এক্ষেত্রে ট্রাম্প -ও অসহায় ছিলেন।  

কেন এত আফগান তালেবানকে বেছে নিল?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, তালেবানই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন যা আমেরিকান দখলদারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং অধিকাংশ আফগানরা আমেরিকার দখলদারিকে  ঘৃণা করতে শুরু করেছে । ৯/১১ হামলার একমাস পর আমেরিকা প্রথম আফগানিস্তানে বোমারু বিমান এবং সৈন্য পাঠায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তরের জোটের বাহিনী সমর্থন করেছিল, দেশের উত্তরে অ-পুশতুন যুদ্ধবাজদের একটি জোট ছিল । কিন্তু জোটের সৈন্য এবং নেতারা আসলে আমেরিকানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যদিকে, তালেবান সরকারকে তখন ক্ষমতায় আসা থেকে প্রতিহত করতে  প্রায় কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মার্কিন, ব্রিটিশ এবং তাদের বিদেশী মিত্ররা বোমা হামলা শুরু করে। পাকিস্তানি সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি আলোচনার মাধ্যমে চলতে থাকা অচলাবস্থার অবসান ঘটায়। সমঝোতায় ঠিক হয় , যুক্তরাষ্ট্রকে কাবুলে ক্ষমতা গ্রহণ এবং তাদের পছন্দের রাষ্ট্রপতি বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে। বিনিময়ে, তালেবান নেতাদের তাদের গ্রামে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে। 'এই সমঝোতার বিষয়টি  সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে সুস্পষ্ট কারণে প্রচারিত হয়নি, কিন্তু আমরা আফগানিস্তানে তখন ছিলাম বলে সবটাই বুঝতে পেরেছিলাম ।' জানাচ্ছেন ন্যান্সি লিন্ডিসফার্ন এবং জোনাথন নিল। এই ঘটনার পর দুই বছর ধরে আমেরিকান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ ছিল না সেদেশে । হাজার হাজার সাবেক তালেবান তাদের  গ্রামে রয়ে  গিয়েছিল। ২০০৩ সালে  ইরাকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে  দখলদারিত্বের প্রথম দিন থেকে ব্যাপক প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছিল। অথবা ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে রাশিয়ার আক্রমণের সময়েও দেশের মানুষের ক্ষোভ দেখেছে বিশ্ববাসী।  কারণটি কেবল এই নয় যে, তালেবানরা যুদ্ধ করতে পারে  না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তালেবানরাও ভেবেছিলো , আমেরিকান কর্তৃত্ব  আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনবে এবং ভয়াবহ দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে । সবথেকে বড় কথা- দেশের প্রত্যেকেই , এমনকি তালেবানরাও তখন শান্তি চাইছিলো।  কারণ একের পর এক যুদ্ধে তারাও ক্লান্ত , বিধস্ত ছিল।  ২০০১ সাল থেকে টানা ২৩ বছর  কখনো কমিউনিস্টদের সঙ্গে  ইসলামপন্থীদের  গৃহযুদ্ধ, কখনো  ইসলামপন্থী এবং সোভিয়েত আক্রমণকারীদের মধ্যে যুদ্ধ, কখনো  দেশের উত্তরে  ইসলামপন্থী যুদ্ধবাজ এবং তালেবানদের মধ্যে যুদ্ধ তাদের ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিলো ভেতর থেকে । তেইশ বছরের যুদ্ধ মানে মৃত্যু,  নির্বাসন , শরণার্থী শিবির, দারিদ্র্য, সেই সঙ্গে অবিরাম ভয় এবং উদ্বেগ। এই সম্পর্কে সেরা বই হল ক্লাইটস এবং গুলমানাডোভা ক্লাইটস এর  লাভ অ্যান্ড ওয়ার ইন আফগানিস্তান (২০০৫)।  মানুষ শান্তির জন্য মরিয়া ছিল। ২০০১ সালের মধ্যেও তালেবান সমর্থকরা মনে করেছিল একটি ভাল যুদ্ধের চেয়ে খারাপ শান্তি ভালো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফুরান অর্থভাণ্ডার দেখে আফগানরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল  যে আমেরিকার দখলদারিত্ব তাদের দেশকে  উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে যা তাদের দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করবে।

আফগানরা অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু  যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ দিয়েছে- শান্তি নয়
আমেরিকা  ও যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিল তালিবানদের একের পর গ্রাম , ছোট শহর, দক্ষিণ ও পূর্বের পুশতুন এলাকা। তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার গোপন সমঝোতার কথা মার্কিন সেনা বাহিনী জানতো না  , যদি জানতো তাহলে তা বুশ সরকারের কাছে খুব সম্মানজনক হত না।  উল্টো সেনাদের বলা হয়েছিল, আফগানিস্তান থেকে যারা খারাপ লোক আছে তাদের সবাইকে নির্মূল করতে হবে।  তার ফলস্বরূপ দিনের পর দিন রাতে  অভিযান চালিয়ে  দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে , পরিবারকে অপমান করে -ভয় দেখিয়ে  পুরুষদের ওপর চলতো অকথ্য নির্যাতন।  আমেরিকান সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দারা নির্যাতনের নতুন সংজ্ঞা তুলে ধরেছিল বিশ্বের সামনে।  যার উল্লেখ রয়েছে ,  আবু  গ্রাইব- এর লেখা বই ' 'আমেরিকান প্রিসন ইন ইরাক'- এ। ধীরে ধীরে আমেরিকানদের প্রতি আফগানবাসি এবং তালেবানদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো।  অনেকে রাতের অন্ধকারে মার্কিন সেনাদের ওপর ছোটোখাটো হামলাও করতো । বদলা নিতে  আমেরিকানরা পরিবারের পর পরিবারকে হত্যা করেছিল বোমারু বিমানে হামলা চালিয়ে।  আফগানিস্তানের  দক্ষিণ ও পূর্ব জুড়ে যুদ্ধ আবারো ফিরতে শুরু করে।
 
বৈষম্য ও দুর্নীতি চরমে ওঠে
আফগানরা এমন উন্নয়নের প্রত্যাশা করেছিল যা ধনী এবং দরিদ্র উভয়কেই উন্নয়নের পথে  নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তারা  আমেরিকার বিদেশ নীতি বুঝতে পারেনি। আমেরিকানরা আফগানিস্তানে টাকা ঢেলে দিয়েছিলো।  যা আফগানদের কাছে পৌঁছেছিল ঠিক , কিন্তু শুধু তাদের কাছে যারা আমেরিকানদের পক্ষে যেতে রাজি হয়েছিল।  টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধবাজদের কাছে , সিআইএ এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত হেরোইন ব্যবসায়ীদের কাছে।  কাবুলে বিলাসবহুল, সুরক্ষিত বাড়িগুলির মালিকদের কাছে,  এবং বিদেশী অর্থে চলা  এনজিও-গুলির কাছে।  আফগানরা দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিতে অভ্যস্ত ছিল। তবে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের মানুষের চোখে অর্থের এই নয়ছয় দুর্নীতি বলে মনে হয়েছিল।গত এক দশক ধরে তালেবানরা  দেশজুড়ে শুধু দুটি জিনিসের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথমটি হল যে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, এবং তারাই  দেশের একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। তালেবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামাঞ্চলে একটি নিজস্ব বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।  তাদের প্রভাব  এতটাই বেশি ছিল যে, শহরে দেওয়ানি মামলার সাথে জড়িত অনেকেই সম্মত হয়েছেন তারা তালেবান বিচারকদের কাছে যাওয়া পছন্দ করতেন  । এটি তাদের ঘুষ ছাড়া দ্রুত, এবং ন্যায্য বিচারের রাস্তা বাতলে দেবে বলে মনে হয়েছিল   । তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ন্যায্য বিচারের পাশাপাশি ছিল  বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা। সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল ধনীরা যখন বিচারকদের ঘুষ দিতে পারে, তাহলে তারা দরিদ্রদের সঙ্গে যা খুশি করতে পারে। ন্যায় বিচার দেবার নাম করে  ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যুদ্ধবাজ এবং সরকারী কর্মকর্তারা ক্ষুদ্র কৃষকদের জমির ওপর দখল নিতে শুরু করেছিল , কিন্তু তালিবান ন্যায়ালয়ে এই বৈষম্য ছিল না। ২০ বছর ধরে।

২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর আফগান রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।  বিশ বছরের যুদ্ধ ও সংকট রাজনৈতিক গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছে।  তালেবানরাও নিজেদের অনেক পরিবর্তন করছে ,তাছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।   অনেক আফগান এবং অনেক বিদেশী বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। গিউস্ততোজি একটি জনপ্রিয় বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন নব্য -তালেবান। এই নতুন তালেবানরা আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছিল , পুশতুন নিয়ে তাদের অন্ধ জাতীয়তাবাদী মনোভাব আসলে তাদের দুর্বলতাকেই সামনে এনে দিয়েছিলো। এরপর থেকে একটা বিষয়েই জোর দিতে লাগলো তালেবানরা , তা হলো- তারা মুসলিম এবং মুসলিম ভাই -বোনেদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় নামলো ।  কিন্তু তালেবান বাহিনীর মধ্যে বিভাজন ছিল । সংখ্যালঘু তালেবান যোদ্ধা এবং সমর্থকরা নিজেদের ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুক্ত করেছে। পার্থক্য হল ইসলামিক স্টেট শিয়া, শিখ এবং খ্রিস্টানদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। পাকিস্তানের তালেবানরাও একই কাজ করে। কিন্তু তালেবানের একটা বিরাট অংশ আবার এই ধরনের সব হামলার নিন্দা করে । নতুন তালেবানরা নারীদের অধিকারের  ওপর জোর দিয়েছে। তারা বলেছে  যে, তারা সঙ্গীত এবং মিউজিক ভিডিওগুলির বিপক্ষে নয়।    তারা আগের শাসনকালের সেই কঠিন দিকগুলি পেছনে ফেলে এসেছে। তালেবানরা এখন জোর দিয়ে একটা কথাই বার বার বলছে যে- তারা শান্তি চায় , যুদ্ধ নয়।  

আফগান মহিলাদের উদ্ধারের বিষয়ে কি হবে ?
আমাদের ১৯৭০- এর দশকে ফিরে গিয়ে শুরু করতে হবে। বিশ্বজুড়ে, লিঙ্গ বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য ভীষণভাবে প্রচলিত ছিল । আফগানিস্তানও তার থেকে আলাদা ছিল না। ন্যান্সি ১৯৭০- এর দশকের গোড়ার দিকে দেশের উত্তরে পুশতুন নারী ও পুরুষদের সাথে নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের কাজ করেছিলেন। তারা কৃষিকাজ ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করত। ন্যান্সির পরবর্তী বই, 'বার্টার্ড ব্রাইডস: পলিটিক্স অ্যান্ড ম্যারেজ ইন আ ট্রাইবাল সোসাইটি,' -তে সেই সময় শ্রেণী, লিঙ্গ এবং জাতিগত বিভাজনের ব্যাখ্যা মেলে । সাদা কথায় বলতে গেলে , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌনতা এবং শ্রেণীর বৈষম্য থেকে  আফগানিস্তান খুব একটা আলাদা ছিল না।  ১৯৭৮ সালে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।  কমিউনিস্ট সরকার এবং ইসলামী মুজাহিদিন-দের মধ্যে বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ। ইসলামপন্থীরা জয়লাভ করছিল, তাই কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯- এর শেষের দিকে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। এরপর সোভিয়েত ও মুজাহিদিনদের মধ্যে সাত বছরের নৃশংস যুদ্ধ চলে।  ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত সৈন্যরা চলে যায়, পরাজিত হয়ে । ১৯৭০- এর দশকের গোড়ার দিকে, কমিউনিস্টরা অন্যরকম ছিল।  তারা দেশের উন্নয়ন করতে চেয়েছিল। তারা বড় জমির মালিকদের থেকে ক্ষমতা নিয়ে  জমি ভাগ করে দিতে চেয়েছিল এবং তারা নারীদের জন্য সমানাধিকার চেয়েছিল। ১৯৭৮ সালে  সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছিল। তারা   সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামবাসীর রাজনৈতিক সমর্থন জিততে পারেনি। ফলাফল এই ছিল যে, বিরোধীদের প্রতিহত  করতে একমাত্র উপায় ছিল গ্রেফতার, নির্যাতন এবং বোমা হামলা। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্টদের সমর্থন করার জন্য আক্রমণ করে। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল বায়ু থেকে বোমা ফেলা, এবং দেশের বড় অংশগুলি ফ্রি ফায়ার জোন করে দেওয়া হয়েছিল । কয়েক লক্ষ আফগান নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল, কয়েক লক্ষ মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে  গিয়েছিলো। ইরান ও পাকিস্তানে ছয় থেকে আট লক্ষ মানুষ পালিয়ে গিয়েছিলো এবং বাকিরা দেশের ভেতরেই থেকে গিয়েছিলো উদ্বাস্তু হয়ে। কমিউনিস্টরা সর্বপ্রথম যা করার চেষ্টা করেছিল তা হলো ভূমি সংস্কার এবং নারীর অধিকারের জন্য আইন। যখন রাশিয়ানরা আক্রমণ করে, তখন অধিকাংশ কমিউনিস্ট তাদের পাশে ছিল। সেই কমিউনিস্টদের অনেকেই ছিলেন নারী। এর ফলাফল ছিল নারীবাদের নামকে নির্যাতন ও গণহত্যার নাম দিয়ে কলঙ্কিত করা। তাই যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয় তখন আফগানিস্তান স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলেছিলো।  

তালিবানদের ফিরে দেখা
১৯৯৪ সালের শরতে, তালেবানরা কান্দাহারে এসেছিল, বেশিরভাগ তখন পশতুন শহর এবং দক্ষিণ আফগানিস্তানের মধ্যে যা বৃহত্তম। আফগান ইতিহাসে তালেবানরা আগে কিছুই ছিল না।তারা আফগানিস্তান শাসনকারী অভিজাতদের থেকে একটি ভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমিউনিস্টরা এই সময়ে শহরে জমিজায়গা নিয়ে বসবাস করতো , তারা বড় জমিদারদের থেকে ক্ষমতা নিয়ে  দেশকে আধুনিক করতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশের ইসলামপন্থী যারা তারা কমিউনিস্টদের সাথে লড়াই করতেন।  তারাও দেশকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন , কিন্তু ভিন্নভাবে। তারা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং কায়রোর আল-আলজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার দিকে তাকিয়েছিলেন । তালেবান শব্দের অর্থ একটি ইসলামিক স্কুলের ছাত্র, রাষ্ট্রীয় স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। তালেবানের যোদ্ধারা যারা ১৯৯৪ সালে কান্দাহারে প্রবেশ করেছিল তারা ছিল যুবক ,যারা পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে বিনামূল্যে ইসলামিক  স্কুলে পড়াশোনা করেছিল। তালেবানের নেতারা আফগানিস্তানের গ্রামের মোল্লা ছিলেন। শহরের মসজিদের অনেক ইমামের মতো অভিজাত সংযোগ তাদের ছিল না। তবে গ্রামের মোল্লারা পড়তে পারতেন, এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা তাদের  শ্রদ্ধার  চোখে দেখতেন । তবে তাদের সামাজিক মর্যাদা খুব একটা  ছিল না। অনেক আফগান শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং কিছুটা নিরাপত্তার জন্য এদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন,কিন্তু তালেবানরা দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম ছিল ।১৯৯৬ সালে আমেরিকানরা সমর্থন তুলে নেবার পর , তালেবানদের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়া নামে এক নতুন এবং মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছিল।  প্রায় রাতারাতি, আফগান মহিলাদের অসহায় এবং নিপীড়িতদের দলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আফগান পুরুষদের - ওরফে তালেবানদের ওপর অত্যাচার সব সীমা লঙ্ঘন করে দিয়েছিলো।  ৯/১১ এর আগে ৪ বছর তালেবানরা আমেরিকানদের লক্ষ্যবস্তু ছিল, দেশের  নারীবাদীরা এবং অন্য আফগান নারীরা  সুরক্ষার দাবী করেছিল। আমেরিকান বোমাবর্ষণ শুরু হওয়ার সময়, সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, আফগান মহিলাদের সাহায্যের প্রয়োজন।

৯/১১ এবং আমেরিকান যুদ্ধ
বোমা হামলা শুরু হয় ৭ অক্টোবর। কয়েকদিনের মধ্যেই তালেবানদের আত্মগোপনে বাধ্য করা হয়েছিল - অথবা আক্ষরিক অর্থেই তাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ডেইলি মেইলের প্রথম পাতায় একটি ছবি প্রকাশিত হয় , যাতে পরতে পরতে ছিল হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ।   দেখে চমকে উঠেছিল বিশ্বের মানুষ।  তবুও  আমেরিকা থামার পাত্র ছিল না।  যেভাবে নির্বিচারে বোমা মেরে আফগান নারী , তাদের স্বামী, সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। নারীবাদী ইসলামোফোবিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক অভিব্যক্তি যুদ্ধের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে  সামনে এসেছিল। প্রতিশোধের নামে  একটি বিশাল অসম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ব।  বিশ্ববাসীর চোখে ধুলো দিতে প্রেসিডেন্ট বুশের স্ত্রী লরা বুশ আফগান মহিলাদের দুর্দশার জন্য শোক প্রকাশ করেছিলেন।  ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার -ও তাঁর শোকবার্তা জানান।  'সেভিং আফগান উইমেন'  নাম নিয়ে এই ধনী যুদ্ধবাজদের স্ত্রীরা আফগানদের ওপর হামলাকে মিডিয়ার সামনে ক্রমাগত ঢাকার চেষ্টা করে। ২০০৮ সালে বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে।  আমেরিকান যুদ্ধবিরোধী জোট কার্যকরভাবে ওবামার প্রচারে সহায়তা করার জন্য নিজেকে বিলুপ্ত করে দেয়।

স্টেরিওটাইপ এবং বিভ্রান্তি
আফগানিস্তানের বাইরে, গত পঁচিশ বছর ধরে তালেবানদের স্টেরিওটাইপ চরিত্র সম্পর্কে ব্যাপক বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু  দেখুন,  আপনি  শুনেছেন যে তারা সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবে বিশ্বাসী , নৃশংস এবং আদিম প্রবৃত্তির । এরাই আবার  ল্যাপটপ নিয়ে  গত চৌদ্দ বছর ধরে কাতারে আমেরিকানদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তালেবানরা মধ্যযুগের ফসল নয়। তারা  বিংশ শতাব্দীর শেষ এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কিছু খারাপ সময়ের ফল। বোমা হামলা, শরণার্থী শিবির, কমিউনিজম,  যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনীতি , নব্য উদারপন্থার সর্পিল বৈষম্যের অধীনে ধীরে ধীরে জীবনকে তৈরি করেছে তালেবানরা । রিচার্ড টেপার যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, উপজাতিরা আতঙ্কবাদী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। দরিদ্র কৃষকদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফসল মাত্র।  আফগানিস্তানে ক্রমাগত একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজনের জেরে তৈরী হয়েছে তালেবান। তালেবানরা দরিদ্র কৃষকদের একটি আন্দোলন মাত্র , সাম্রাজ্যবাদী দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মাত্র।  কখনও কখনও তা  সাম্প্রদায়িক, কখনো তা নয়।  ইতিহাসের পাতায় নানা যুক্তি তর্কের একটি মিশেল এই তালেবান।  বিভ্রান্তির আরেকটি উৎস হলো,  তালেবানের শ্রেণী রাজনীতি। তারা একদিকে  যেমন দরিদ্রদের পাশে আছে , অন্যদিকে তারা সমাজতন্ত্রের এতটা বিরোধী।

আমেরিকায় একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন
কাবুলের পতন বিশ্বব্যাপী আমেরিকান শক্তির জন্য একটি চূড়ান্ত পরাজয়। যার প্রমাণ হচ্ছে,  ২০০১ সালে, ৯/১১ হামলার  ঠিক পরে, ৮৫% থেকে ৯০% আমেরিকানরা আফগানিস্তান আক্রমণের অনুমোদন দিয়েছিল। পরে তা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার বাইডেনের সিদ্ধান্তকে গত মাসে সমর্থন করেছিলেন ৬২ % মানুষ , ২৯ % এর এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন।  বাইডেন এবং ট্রাম্প দু'জনেই যুদ্ধের বিপক্ষে।  কারণ অনেক সামরিক বাহিনী আসে আমেরিকার গ্রামাঞ্চল থেকে যেখানে আবার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের  জন্য ব্যাপক সমর্থন ছিল ।  তাই সেই সমর্থন যাতে হাত থেকে বেরিয়ে না যায় তাই ট্রাম্প  যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না ।  মার্কিন সৈন্যরাও মনে করেন এখন আমেরিকার বিশ্বের সব বিষয়ে নাক গোলানো উচিত নয়। ডেমোক্র্যাটরা যুদ্ধের বিপক্ষে।  তবে ডেমোক্র্যাট  বারাক ওবামা ,  রিপাবলিকান রোমনি -র মতো ওয়াশিংটনের অভিজাত শ্রেণীর প্রায় সবাই সামরিক হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমেরিকান জনগণ এবং বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী নয়।  সাইগনের পতনের পর, আমেরিকান সরকার পরবর্তী ১৫ বছর ধরে বড় ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করতে পারেনি। কাবুলের পতনের পর এটি আরও দীর্ঘ হতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরিণতি
১০৩ বছর ধরে প্রচলিত আছে,  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি আছে - যেমন  জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এখন চীন । কিন্তু আমেরিকা তাদের থেকেও বেশি প্রভাবশালী সেই ধারণা এখন অতীত।  দীর্ঘমেয়াদী কারণ হলো, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক অর্থনৈতিক পতন। কিন্তু কোভিড মহামারী এবং আফগান পরাজয় গত দুই বছরে বিস্তর পরিবর্তন এনেছে । কোভিড মহামারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি এবং সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক অযোগ্যতা প্রকাশ করেছে। সরকার জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই বিশৃঙ্খল এবং লজ্জাজনক ব্যর্থতা বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে সুস্পষ্ট। এরপর আছে আফগানিস্তান। যেখানে দরিদ্র মানুষগুলির ধৈর্য এবং সাহসের কাছে পরাজিত হয়েছে  মার্কিন সামরিক বাহিনী।  তালেবানদের বিজয় সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং মালির বিভিন্ন ধরণের ইসলামপন্থীদের হৃদয় জিতে নিয়েছে ।  এখন তাই  কোনো সরকার বিশ্বাস করবে  না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিদেশী হানাদার থেকে রক্ষা করতে পারবে।  এটাই  আমেরিকার শেষের শুরু।

এখন কি  ঘটছে?
আগামী কয়েক বছরে আফগানিস্তানে কী হবে তা কেউ জানে না। প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি যা চোখে পড়ছে তা হলো, আফগানদের হৃদয়ে শান্তির গভীর আকাঙ্ক্ষা। তারা গত  ৪৩ বছর যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। কাবুল, কান্দাহার এবং মাজার, তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরের পতন হয়েছে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই । তালেবানরা বার বার  বলে আসছে, তারা শান্তিতে একটি দেশ গঠন করতে চায়, এবং তারা কোনো প্রতিশোধ নিতে চায় না। তালেবান নেতারা বিলক্ষণ জানেন, সচেতন যে তাদের অবশ্যই দেশবাসীকে শান্তি প্রদান করতে হবে। এটাও অপরিহার্য যে, তালেবানদের প্রকৃত  ন্যায়বিচারের পথে হাঁটতে হবে , কোনো দেশ বা বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নত করলে চলবে না।   আফগানিস্তান একটি দরিদ্র এবং শুষ্ক দেশ, যেখানে ৫% এরও কম জমিতে চাষ করা যায়। দেশের অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে আফিম চাষ এবং তার রফতানির ওপর। এর পাশাপাশি  বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া, দেশের অর্থনৈতিক পতন ত্বরান্বিত হতে পারে   ।কারণ তালেবানরা এটা জানে, তারা স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে আসছে। আমেরিকানরা সাহায্য দেবে, এবং বিনিময়ে তালেবানরা সন্ত্রাসীদের সমর্থন করবে না  যারা ৯/১১ এর মতো হামলা চালাতে পারে। ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রশাসন উভয়ই এই চুক্তি মেনে নিয়েছে। কিন্তু এটা মোটেও স্পষ্ট নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে কিনা । কারণ পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসন ইরাক, ইরান, কিউবা এবং ভিয়েতনামকে দীর্ঘদিন ধরে ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে গেছে।  মানবাধিকারের নামে আফগান শিশুদের অনাহারে রাখার মতো ঘটনাও সামনে এসেছে। এখানেই শেষ নয় ,  আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা জাতিগত শক্তিকে সমর্থনকারী  আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের হুমকিও  রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, চীন, রাশিয়া এবং উজবেকিস্তান সবাই  প্রলুব্ধ হবে নিজেদের মতো হুকুম চালাতে । এটি আগেও ঘটেছে এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে এটি  যুদ্ধকে উস্কে দিতে পারে। আপাতত, যদিও ইরান, রাশিয়া এবং পাকিস্তানের সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আফগানিস্তানে শান্তি চায়। তালেবানরা নিষ্ঠুরতার সাথে শাসনভার  না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে মুখে বলার সঙ্গে কাজে করার অনেক ফারাক আছে।
 
এখন কী করার আছে ?
পাশ্চাত্যের অনেকেই এখন প্রশ্ন করছেন, "আফগান মহিলাদের ,কট্টর নারীবাদীদের সাহায্য করার জন্য আমরা কি করতে পারি? উত্তর হলো- তাদের বিমানের টিকিট কেনার এবং তাদের ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য সংগঠিত করা। কিন্তু শুধু নারীবাদীদেরই আশ্রয় দিলে চলবে না। পেশার জন্য কাজ করা হাজার হাজার মানুষ তাদের পরিবারের সাথে আশ্রয়ের জন্য মরিয়া। এর কারণ ২০ বছর ধরে ন্যাটো বাহিনীর অত্যাচারে তারা বিপর্যস্ত।  অনেকেই কাছের লোককে হারিয়েছেন , তাই যাদের কারণে আফগানদের এই পরিণতি দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমেরিকার কর্তব্য।  অভিবাসনের নামে  বর্ণবৈষম্য জনসন এবং বাইডেন সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে ।  অবিলম্বে এই ইসলামবিরোধী মনোভাব দূর না করলে নিজের ভাবমূর্তি বদলানো সম্ভব নয়।  প্রত্যেক রাজনীতিবিদ, যিনি আফগান নারীদের সমর্থনে কথা বলেন, তাকে বারবার সব আফগানদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ করা উচিত সরকারের কাছে।  আমরা  যারা ঘরে বসে রোজ টিভি , খবরের কাগজে আফগানিস্তানের খবর পড়ছি , তাদের উচিত সেই দেশের মানুষগুলির জন্য শান্তি প্রার্থনা করা।  যাতে এতো বছরের অশান্তি শেষে তারা যেন একটু মুক্ত আকাশ শ্বাস নিতে পারেন।  


সূত্র : annebonnypirate.org
ন্যান্সি লিন্ডিসফার্ন(স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের গবেষক) এবং জোনাথন নিলে( বৃটিশ ব্যবসায়ী এবং ম্যাকলরেন গ্রুপের প্রধান অপারেটিং কর্মকর্তা)'র কলমে :
অনুবাদ : সেবন্তী ভট্টাচার্য্য

No comments

Powered by Blogger.