যেভাবে আখ্যান থেকে আখ্যানে বয়ে গেছে ভালোবাসার নদী চেনাব by হারুন খালিদ

সোহনি এবং মাহিওয়ালের প্রেম কাহিনীতে মাটির ঘড়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাঞ্জাবি এই ফোক গল্পের শেষে সোহনি মাহিওয়ালের সাথে দেখা করার জন্য চেনাব নদী পার হয়। মাহিওয়াল নদীর ওপারে তার জন্য অপেক্ষা করছি। সোহনির ঘড়া তার হাতের মধ্যে গলতে শুরু করে। প্রতিদিনই প্রিয়তমের সাথে দেখা করার জন্য এই ঘড়া নিয়ে নদী পার হতো সে। কিন্তু শেষ দিন সে জানতো না যে, তার ননদ তার অজান্তেই প্রতিদিনের ঘড়া বদলে সেখানে কাঁচা মাটির একটা ঘড়া রেখে দিয়েছিল।
জনপ্রিয় সুফি কবিতায় এই ঘড়া, সোহনি এবং মাহিওয়াল – প্রত্যেকেরই প্রতীকী অর্থ আছে। মাহিওয়াল এখানে পরম ভালবাসার পাত্র বা আধ্যাত্মিক লক্ষ্য, সোহনি হলো আত্মত্যাগী ধর্মভীরু যে সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে এবং চেনাব এ ক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যম। কিন্তু ধর্মভীরুর প্রচেষ্টা এখানে এককভাবে পূরণ হয় না। অনেক কাহিনী রয়েছে যেখানে বিভিন্ন ধর্মভীরু পরম সত্য জানার চেষ্টা করতে গিয়ে গাইডের অভাবে উন্মাদ হয়ে গেছে। তাই প্রত্যেক অনুসন্ধিৎসুরই একজন শিক্ষক, পৃষ্ঠপোষক, মুরশিদ প্রয়োজন। শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক গুরুর সংস্পর্শে থেকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। পাঞ্জাবি সুফি কবিতায় এই ঘড়ার ভূমিকা সেটাই। এটার সাহায্য নিয়েই সোহনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাহিওয়ালের সাথে দেখা করতো।
চেনাব নদী পার হয়ে নৌকা থেকে নামছেন পাকিস্তানের গ্রামবাসী, ছবি: এএফপি
সোহনি যখন স্রোতের মধ্যে পড়ে, তার ঘড়া ক্রমেই পিছলে যেতে থাকে। নতুন একটি প্রতীকের জন্ম হয় এখানে। অনেক গুরু ভক্তদের এই কঠিন সফরে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেও এমন হতে পারে যে সে নিজেই প্রশিক্ষিত নয়। সে ক্ষেত্রে ভক্ত ও গুরু উভয়েই এই কঠিন পথে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে পারে।
নদীর পাশে
যে নদী সোহনিকে গিলে ফেলেছিল, সেখানেই জন্ম নিয়েছিল সাহিবান। সোহনির মতো সেও চিল হিয়ার। নদীর অল্প দূরেই খেইওয়া গ্রাম। এর পাশেই কৃষিক্ষেতে একটা ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে যেখানে বাল্যকালে একসাথে লেখাপড়া করেছিল মির্জা আর সাহিবান। তাদের বাল্যকালের প্রেম যখন বড় হচ্ছিল, সাহিবানের বাবা-মা তখন ভিন্ন চিন্তা করেছিলেন। চাচাতো ভাইয়ের সাথে সাহিবানের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তারা।
পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। মির্জা ঘর ছাড়ার আগে তার মা তাকে সতর্ক করে বলে যে সাহিবান সিয়ার গোত্রের মেয়ে এবং এই গোত্রের মেয়েরা হয় খারাপ। মির্জা অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নয়। রাঞ্ঝার যেটা ছিল না, সেই তীর-ধনুক ছিল তার। ছিল বলবান ঘোড়া। কিন্তু মির্জা আর সাহিবানের পরিণতিও ছিল ট্রাজিক। সাহিবানের ভাইয়েরা তাদের হত্যা করে, যারা নিজেদের ‘সম্মান’ রক্ষা করছিল।
চেনাব নদীর কাছে ঐতিহাসিক ঝাং শহরের প্রান্তে মাহি হিরের মাজার, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
চেনাব নদী থেকে বেশি দূরে নয় ঐতিহাসিক ঝাং শহর। শহরের প্রান্তে মাহি হিরের মাজারে প্রতিদিন ভিড় করে শত শত পূণ্যার্থী। মাজারের মাঝখানে হির আর রাঞ্ঝাকে একই কবরে কবরস্থ করা হয়েছে। চূড়ান্ত এই মিলন সুফি কবিতার ঐতিহ্যিক প্রতীক হয়ে আছে।
প্রতীক হিসেবে নদী
হির এভাবেই আদর্শ ভক্তের প্রতীক হয়ে আছেন। আর তার প্রেম কাহিনী পরবর্তী প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য পথ দেখিয়েছে। সোহনি এবং সাহিবানের মধ্যেও একজন হির ছিল। অন্যদিকে মাহিওয়াল আর মির্জার মধ্যে রাঞ্ঝার ছায়া খুঁজে পান অনেকে। এই গল্পগুলোকে যখন একত্রে দেখা হয়, আরেকটি প্রতীকের আবির্ভাব হয় সেখানে – একটা নদীর প্রতীক – চেনাব নদী – যেটা সমস্ত আখ্যানকে এক সূতায় গেঁথেছে। এক আখ্যান থেকে আরেক আখ্যানে ছড়িয়ে গেছে যেটা। এই সব প্রেমের আখ্যানের সাক্ষি হিসেবে ভালোবাসার নদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে চেনাব।
হারুন খালিদ চারটি বইয়ের লেখক। তার সাম্প্রতিক বই – ‘ইমাজিনিং লাহোর: দ্য সিটি দ্যাট ইজ, দ্য সিটি দ্যাট ওয়াজ’। পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউজ এই বইটি প্রকাশ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.