পাকিস্তানে গোপন মানবাধিকার লঙ্ঘন by এম ইলিয়াস খান

নিউ ইয়র্কে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ অভিযানে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীরা যেসব হত্যা ও নির্যাতন করেছে তার প্রমাণ সবেমাত্র প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে বিরল কিছু ডকুমেন্ট পেয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক এম ইলিয়াস খান। এসব নিয়ে তিনি অনলাইন বিবিসিতে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এর শিরোনাম ‘আনকাভারিং পাকিস্তানস সিক্রেট হিউম্যান রাইটস অ্যাবিউজেস’। অর্থাৎ পাকিস্তানে গোপনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য উদঘাটন
এম ইলিয়াস খান লিখেছেন, সময়টা ২০১৪ সালের শুরুর দিকের।
সেনাবাহিনী ভুল প্রমাণ দিলেন আদনান রশিদ
ওই সময় টিভি নিউজ নেটওয়ার্কগুলো পাকিস্তানি তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বড় বিজয়ের খবর প্রচার করতে থাকে। বলা হয়, রাতে আকাশ পথে ঘেরাও দিয়ে এই গ্রুপটির সবচেয়ে সিনিয়র কমান্ডারদের একজনকে হত্যা করা হয়েছে। বলা হয়, আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের উপজাতি এলাকায় হামলায় আদনান রশিদ ও তার পরিবারের ৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আদনান রশিদ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক একজন টেকনিশিয়ান। তিনি সুপরিচিত ছিলেন। মালালা ইউসুফজাইকে তিনি একটি ব্যতিক্রমী চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলার চেষ্টা করেছিলেন, কেন মালালার ওপর হামলা হয়েছিল। এ ছাড়া পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফকে হত্যা চেষ্টার দায়ে তিনি জেলে ছিলেন। তবে সেখান থেকে পালিয়ে বেরিয়ে যান।
নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলো রিপোর্ট করে যে, ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি হামজোনি এলাকায় আদনান রশিদের গোপন আস্তানা টার্গেট করা হয় দু’রাত আগে থেকে। ৯/১১ হামলার পর আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই ওয়াজিরিস্তান ও বিস্তৃত পাহাড়ি উপজাতি এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তারা ওই অঞ্চলকে কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলে। কারণ, মনে করা হয়েছিল তালেবান যোদ্ধা, আল কায়েদার যোদ্ধা ও অন্যান্য জঙ্গিরা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে।
কিন্তু ওই এলাকায় বা অভিযানের সময় সেখানে সাংবাদিক বা বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি। তাই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা যেসব দাবি করে বা করছে তা যাচাই করা চরম মাত্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে। এক বছর পরে সেনাবাহিনীর ওই দাবি ভুল প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ তারা ভুল নিশানায় টার্গেট করেছিল। কারণ, সেনাবাহিনীর এই ভুল নিশ্চিতভাবে ধরিয়ে দেন আদনান রশিদ। তিনি একটি ভিডিওতে প্রমাণ দেন যে, তিনি জীবিত আছেন। প্রকৃতপক্ষে শীর্ষ এই জঙ্গিকে হত্যার পরিবর্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে স্থানীয় এক ব্যক্তির পরিবারকে। সেনাদের ওই হামলায় তার বাড়িটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যে ভুল করেছে, এ বিষয়টি তারা কখনো স্বীকার করেই নি। ঘটনাটি ঘটেছিল দেরা ইসমাইল খান এলাকায়। এ শহরটি ইন্দুস নদীর তীরে অবস্থিত। উপজাতি এলাকায় প্রবেশের প্রবেশদ্বার হিসেবে দেখা হয় এটাকে। ঘটনা তদন্তে বিবিসির সাংবাদিক ওই এলাকায় সফরে যান, যে ব্যক্তির বাড়িতে হামলা হয়েছিল তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে।
ওই সময় নাজিরুল্লাহর বয়স ছিল ২০ বছর। তিনি বলেন, হামলাটি হয়েছিল স্থানীয় রাত ১১টা বা এর আশপাশের সময়ে। তখন সম্প্রতি বিয়ে করেছেন তিনি। তারা একরুমের বাসায় বসবাস করতেন। পরিবারের বাকি সদস্যরা অন্য এক রুমে গাদাগাদি করে ঘুমান। তাদের গ্রামের নাম খাতেই কালে। নাজিরুল্লাহ বলেন, হামলায় পুরো বাড়িটি যেন বিস্ফোরিত হয়েছিল। আমরা ঘুমে ছিলাম। আমি ও আমার স্ত্রী কাঁপতে কাঁপতে ঘুম থেকে জেগে যাই। বাতাসে তখন কড়া গানপাউডারের গন্ধ। আমি ও আমার স্ত্রী দৌড়ে বাড়ির বাইরে এলাম। দেখলাম আমাদের রুমের পুরো ছাউনি বা ছাদ ধসে পড়েছে। বাকি শুধু আমরা যেখানে ঘুমিয়েছিলাম, তাই কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয় রুমটিও ধসে পড়েছে। চারদিকে শুধু আগুন জ্বলছে তখন। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম। আগুনের ভিতর জ্বলছে এমন মানুষদের সাহায্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম আমি ও আমার স্ত্রী। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছিলেন প্রতিবেশীরা। আমরা উদ্ধার করছিলাম আহত ও নিহতদের। ওই হামলায় মাত্র ৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে শিশু সহ নাজিরুল্লাহর পরিবারের চার সদস্য নিহত হন।
নাজিরুল্লাহ বলেন তার ভাতিজি সুমাইয়ার তখন বয়স মাত্র এক বছর। তাকে রেখে তার মা নিহত হন। সুমাইয়ার কোমরে মারাত্মক ক্ষত হয়। পরিবারের বাকি চার সদস্যকে ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের সবার হাড় ভেঙে গেছে। বাকিরা আহত হয়েছে।
পাকিস্তানের এই অংশে বসবাসকারী বহু মানুষ বিদ্রোহী বা জঙ্গিদের কারণে বার বার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন।  কর্তৃপক্ষ ও নিরপেক্ষ গবেষণাকারী গ্রুপগুলো বলছে, ২০০২ সালে জঙ্গিদের সহিংসতার পর থেকে কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তারা আশ্রয় নিয়েছে সরকার পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে অথবা শান্তিপূর্ণ কোনো এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে পাকিস্তানে কি পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন তার কোনো সরকারি তথ্য নেই। তবে শিক্ষাবিদ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন অধিকারকর্মীরা মনে করেন বেসামরিক, জঙ্গি ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী মিলে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।
যেভাবে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটে পাকিস্তানে

পাকিস্তানে সিক্রেট বা গোপনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা, বিশেষত সেনাবাহিনী। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করে না। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে নিহত হয়েছেন বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ। এখন তারা এ দাবির পক্ষে ভিডিও ও তথ্য সংগ্রহ করছে। এমন অধিকারকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নতুন একটি অধিকার বিষয়ক সংগঠন পশতুন তাহাফফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম)। এ সংগঠনটি গত বছরই চালু হয়েছে। তারা উপজাতি এলাকাগুলোতে মানবাধিবার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রকাশ করে যাচ্ছে, যেখানে নির্যাতিত মানুষ আগে কথা বলতে ভয় পেতেন। অনলাইন বিবিসিতে দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক এম ইলিয়ান খান।
পিটিএমের শীর্ষ নেতা মানজুর পশতিন। তিনি বলেছেন, দুর্ভোগ ও অবমাননার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় ১৫ বছর। এ সময়ে আমরা সচেতনতা সৃষ্টি করেছি, কিভাবে সরাসরি হামলা চালিয়ে এবং জঙ্গিদের সমর্থন দিয়ে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার নষ্ট করছে সেনাবাহিনী।
কিন্তু তার এ গ্রুপটি প্রচন্ড চাপে রয়েছে। তারা বলেছে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন বিক্ষোভ করছিলেন, তখন তাদের ওপর ২৬ মে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় সেনাবাহিনী। এতে তাদের ১৩ জন অধিকারকর্মী নিহত হয়েছেন। তবে সেনাবাহিনী বলেছে, চেকপয়েন্টে হামলা চালানোর পর তারা অভিযানে গেছে এবং এতে কমপক্ষে তিনজন অধিকারকর্মী নিহত হয়েছেন। তাদের এ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে পিটিএম। বর্তমানে এ গ্রুপের দু’জন এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পিটিএম।
বিবিসি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেছে এমন বেশকছিু ঘটনার উল্লেখ করেছে পিটিএম। এসব বিষয় পাকিস্তানি সেনা মুখপাত্রের সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি। তিনি এসব অভিযোগকে উচ্চমাত্রায় বিচারিক বলে মত দেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকারের কাছ থেকেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পায় নি বিবিসি।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদার হামলার পর নতুন একটি সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র যখন ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে হামলা চালায়, তখন আল কায়েদার নেতা প্রয়াত ওসামা বিন লাদেনের ছত্রছায়ায় থাকা তালেবান বাহিনী আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন যে তিনটি দেশ তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তার অন্যতম হলো পাকিস্তান। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটি স্বার্থ ছিল। তারা চাইছিল আফগানিস্তানে ভারত যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তা রোধ করতে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল পাকিস্তান। ফলে তখনকার সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। এ থেকে যা দাঁড়িয়েছে তা হলো, তালেবানরা পাকিস্তানের আধা শায়ত্তশাসিত উপজাতি এলাকাগুলোতে আশ্রয় খুঁজে পায়। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে।
কিন্তু ঘটনা অন্য। আফগানিস্তানের তালেবানরা সীমান্ত অতিক্রম করার সময় শুধু নিজেরাই আসে নি। বিভিন্ন রকম গ্রুপের বিভিন্ন রকম জঙ্গি উপজাতি এলাকাগুলোতে প্রবেশ করে। এর মধ্যে এমন কিছু জঙ্গি ছিল, যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের খুব বিরোধী নয়। ওয়াজিরিস্তান থেকে হামলা ষড়যন্ত্র শুরু করে বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষী জিহাদিরা। এ কারণে ওয়াশিংটন থেকে দাবি ওঠে। তারা ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদ ভেঙেচুরে দেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। পাকিস্তানের একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ‘মিলিটারি ইনকরপোরেশন: ইনসাইড পাকিস্তানস মিলিটারি ইকোনমি’ বইয়ের লেখক আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ফলে পাকিস্তান একদিকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে অন্যদিকে ভবিষ্যত দরকষাকষিতে অংশীদারদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা করে।
২০১৪ সালে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নতুন করে অভিযান শুরু করে পাকিস্তান। এতে জঙ্গি গ্রুপ ও তাদের নিরাপদ আস্তানায় চাপ বৃদ্ধি পায়।

No comments

Powered by Blogger.