অগাস্ট ১৯৭৫-এর পর শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রচার মাধ্যম থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা যেভাবে করা হয়েছিল by সানজানা চৌধুরী

শেখ মুজিবুর রহমান
১৫ অগাস্ট ২০১৯ বিবিসি বাংলা:: ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশের কোন প্রচার মাধ্যম এমনকি চলচ্চিত্রেও তাঁর নাম বা ছবি প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।
তৎকালীন সরকারি প্রচার মাধ্যমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ মুজিবকে হত্যার পর এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা নানাভাবে ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।

বেতারে শেষবারের মতো শেখ মুজিবের নাম

শেখ মুজিবকে হত্যার পর পর ভোর বেলায় শাহবাগের বাংলাদেশ বেতারের ব্রডকাস্ট শাখা থেকে হত্যাকাণ্ড সেই সঙ্গে সামরিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল।
ঘটনার দিন বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগ ব্রডকাস্ট শাখার শিফট ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছিলেন প্রণব চন্দ্র রায়।
''সেদিনই শেষবারের মতো উচ্চারিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি। এরপর থেকে বেতারে কখনও তার নাম শোনা যায়নি'', মি. রায় বিবিসিকে বলেন ।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান যে, ভোরবেলা সেনাবাহিনী বেতার অফিসের ভেতরে ট্রান্সমিশন কক্ষে প্রবেশ করে এবং তার মাথার ওপর বন্দুক ঠেকিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যার ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করে দিতে বলে।
"মেজর ডালিম আমার মাথায় বন্দুক ঠেকায়, তারা পুরো শরীর তখন রক্তে ভরা। আমি তখনও জানতাম না কি হয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বলেন, শেখ মুজিব অ্যান্ড হিজ গ্যাং অল হ্যাজ বিন কিল্ড। আর্মি হ্যাজ টেকেন পাওয়ার। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তখন বুঝলাম যে ক্যু হয়েছে।" বলেন মিঃ রায়।
তারপর তিনি সেনাবাহিনীর নির্দেশ মতো রেডিওর সব ইকুইপমেন্টগুলো খুলে দেন এবং মিরপুরের ট্রান্সমিশন স্টুডিওকে বলেন ঘোষণাটি প্রচার করার জন্য।
মেজর শরীফুল হক ডালিম একটা লগ বুকের কাগজে বিবৃতি লিখেন এবং সেটাই প্রচার করেন।
যেখানে বলা হয়েছিল, "শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে এবং খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দেশবাসী সবাই শান্ত থাকুন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।"
পর পর কয়েকবার এই ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তী রেকর্ডিংয়ে শেখ মুজিবকে "হত্যা করা হয়েছে" বলার পরিবর্তে "উৎখাত করা হয়েছে" বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
জানুয়ারি ৮, ১৯৭২: লন্ডনের ক্ল্যারিজ'স হোটেলে গণমাধ্যমের মুখোমুখি শেখ মুজিব
ওই মুহূর্তে মেজর শাহরিয়ার রশিদ কড়া নির্দেশনা দেন যেন শেখ মুজিবুর রহমান বা তার দলের নাম, রবীন্দ্র সংগীত, জয় বাংলা স্লোগান কিছুই প্রচার করা না হয়।
পরে খন্দকার মুশতাক তার মৌখিক নির্দেশে বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও বাংলাদেশ রাখেন।

বাংলাাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়নি শেখ মুজিবের নাম ও ছবি

এই সময়ের মধ্যে বিটিভিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হতে শোনেননি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ।
তিনি সে সময় বিটিভির প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
সেখানে থাকাকালীন তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করা হয়েছিল।
কিন্তু প্রামাণ্য চিত্রটি প্রচারের আগ মুহূর্তে নামটি কেটে দেয়া হয়।
২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিনগুলোয় হাতে গোনা দুই একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গটি জোড়াতালি দিয়ে কোন রকম দাঁড় করানো হতো বলে উল্লেখ করেন মিঃ হামিদ।
এমনকি পাঠ্যবইতে শেখ মুজিবের নাম মুছে খণ্ডিত ইতিহাস পড়ানো হতো বলে তিনি জানান।
১৫ আগস্টে পালন করা হতো জাতীয় নাজাত (মুক্তি) দিবস। ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ইতিহাস বা তাকে হত্যার ঘটনা কিছুই প্রচার করা হতো না।
মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৭৪ সালে ধারণ করা একটি ছবিতে শেখ মুজিব
উল্টো বিটিভিতে প্রচারিত বিভিন্ন বক্তৃতা এবং আলোচনায় শেখ মুজিবকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হতো বলে জানা যায়।
"বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে যারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিল তারা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে পুরোপুরি বিপরীত ধারায় নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ আসলেই তারা ভয় পেতো, মানুষ যদি আবার তাঁর ব্যাপারে জানতে শুরু করে। এজন্য প্রচার প্রোপাগান্ডার মধ্যে দিয়ে তার নাম ও আদর্শকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সার্বিক প্রয়াস চালানো হয়েছিল,'' বলেন ম হামিদ।

চলচ্চিত্রে সেন্সর বোর্ডের কাটছাট

পঁচাত্তর পরবর্তী চলচ্চিত্রেও শেখ মুজিবের নাম ছবি এমনকি জয় বাংলা স্লোগান ব্যবহার হতে দেখা যায়নি।
সেসময় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সারাহ বেগম কবরী।
তার অভিনীত রক্তাক্ত বাংলা এবং আমার জন্মভূমি চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকটি অংশ এবং সংলাপ সেন্সর বোর্ড থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
যার মধ্যে ছিল শেখ মুজিবের নাম, তাঁর ছবিযুক্ত শট, তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ এবং জয় বাংলা স্লোগান।
"সে সময় যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা ইচ্ছামত রাজনৈতিকভাবে চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। তাদের কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর নাম বা তার দলের কোন চিহ্ন যেন কোথাও না থাকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক ছবিতেও এই বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছিল,'' সারাহ বেগম কবরী বিবিসিকে বলেন।

পুনরায় বাংলাদেশ বেতার, তথ্য পুনরুদ্ধার

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আবু সাঈদ।
সে সময় তিনি 'রেডিও বাংলাদেশ'-এর নাম, মৌখিক নির্দেশে পুনরায় 'বাংলাদেশ বেতার' রাখেন।
নতুন প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবের ইতিহাস তুলে ধরতে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
"আমি বেতারের ডিজি সাহেবকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম বাংলাদেশ বেতার রাখা হয়েছিল। এটা রেডিও পাকিস্তানের আদলে রেডিও বাংলাদেশ কিভাবে হল? ডিজি সাহেব এ নিয়ে আমাকে লিখিত কোন নথি বা আদেশনামা দেখাতে পারেননি। কেবল একটি মৌখিক নির্দেশে এই নাম পরিবর্তন হয়েছিল। তারপর আমি পাল্টা নির্দেশ দিলাম এটাকে আবার বাংলাদেশ বেতার করতে,'' বলেন মি. সাঈদ।
মি. সাঈদ সে সময় ডিএফপি এর আর্কাইভ থেকে শেখ মুজিবের সব রেকর্ডগুলো কয়েক বছর ধরে পুনরুদ্ধার করেন এবং রেডিও টেলিভিশন ও পত্রিকায় প্রচার করা শুরু করেন।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাষণ।
"আমি আর্কাইভে গিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রিলগুলো অযত্ন অবহেলায় স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে নষ্ট হচ্ছে। তখন আমি সেগুলো বের করে ওয়াশ করার জন্য ভারতের পুনেতে পাঠাই। কারণ বাংলাদেশে ওই প্রযুক্তি ছিলনা। এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতো ভিজুয়াল দেখেন, বেশিরভাগ সেই সময়ের উদ্ধার করা,'' তিনি বলেন।
পরিবারসহ শেখ মুজিবুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.