হিন্দু পণ্ডিতদের জন্য কাশ্মিরে তাদের বাড়িঘরে ফেরা বিকল্প নয় by উমর মনজুর শাহ

৪৭ বছর বয়স্ক কাশ্মিরি পণ্ডিত সুনীল ভাটের কাছে কাশ্মিরে তার বাড়িতে ফেরার সুযোগ নেই। জঙ্গিরা যখন কাশ্মিরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরে বসবাসকারী হাজার হাজার কাশ্মিরি হিন্দু তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
মুসলিম কাশ্মিরি তরুণরা ভারতীয় শাসন থেকে তাদের রাজ্যকে মুক্ত করার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে গিয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন কট্টরপন্থী ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। তারা মদের দোকান বন্ধ করার দাবি জানায়, সিনেমা হলগুলো পুড়িয়ে দেয়, হিন্দুদের এলাকা ত্যাগ করতে বলে।
দক্ষিণ কাশ্মিরের সোপিয়ান অঞ্চলের (এখনো এলাকাটি জঙ্গিদের জন্য প্রাণবন্ত এলাকা) অধিবাসী ভাটের পরিবার আরো হাজার হাজার হিন্দু পরিবারের মতো রাতের গভীরে তাদের বাড়িঘর, ফসলভরা ক্ষেত, গবাদি পশু ফেলে পালিয়ে যায়।
উপত্যকার হিন্দুদের বেশির ভাগই ছিল ব্রাহ্মণ, তাদের বলা হতো পণ্ডিত। ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে আজাদি আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠলে তারা বাড়িঘর ত্যাগ করে। ওই সময় জঙ্গিদের হাতে প্রায় ২০০ পণ্ডিত নিহত হয়।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার নিবন্ধিত কাশ্মিরি অভিবাসী পরিবার রয়েছে। জম্মুতে বাস করছে প্রায় ৩৮,১১৯টি নিবন্ধিত কাশ্মিরি অভিবাসী পরিবার, দিল্লিতে ১৯,৩৩৮টি, অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যে ১,৯৯৫টি পরিবার।
কাশ্মির থেকে পালানোর পরপরই ভাট হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল জম্মুতে একটি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন, নিজ সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে বিয়ে করেন।
এখন তিনি দুই সন্তানের পিতা। তিনি কাশ্মিরে ফিরে যেতে আগ্রহী নন। কাশ্মিরি হিন্দুদের বেশির ভাগের মনে এখন এ ধরনের ভয়ই বিরাজ করছে।
সাউথ এশিয়ান মনিটরকে ভাট বলেন, আমি সেখানে গিয়ে মরতে চাই না। আমি চাই না আমার সন্তানেরা নিহত হোক স্রেফ এই কারণে যে তাদের বাবা তার শৈশবের বাড়িতে ফিরে যেতে চেয়েছিল।
জম্মু ও কাশ্মির সরকার কাশ্মিরি পণ্ডিতদের ফিরিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক ও চাকরির প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজ ছাড়াও সরকার এমন ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করছে যে কাশ্মিরে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তারা সত্য জানে। আর সেজন্যই ফিরতে রাজি হচ্ছে না।
জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এনকাউন্টারে নিহত নয়। তার হত্যার পর উত্তাল হয়ে ওঠে কাশ্মির। ফলে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর প্রয়াস স্তম্ভ হয়ে যায়। ছয় মাস ধরে চলা রাজপথের বিক্ষোভে ৯০ জন নিহত ও ১১ হাজারের বেশি লোক আহত হয়।
এই সময় দক্ষিণ কাশ্মিরে একটি পণ্ডিত অভিবাসী ক্যাম্পে পাথর দিয়ে হামলা চালায় মুসলিম তরুণেরা। সরকারি চাকরি পেয়ে ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১৯ শ’ কাশ্মিরি পণ্ডিত পালিয়ে যায়।
ভাট বলেন, জীবন-মৃত্যু যেখানে অবিচ্ছিন্ন এবং যেখানে অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা লেগে আছে, সেখানে তার সন্তানেরা বাস করুক, তা তিনি চান না।
তিনি বলেন, সরকার যদি কাশ্মিরে আমাদের জন্য সোনা আর হীরায় মোড়ানো প্রাসাদও নির্মাণ করে, তবুও সেখানে যাব না। আমরা আমাদের নিরাপত্তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা জানি না, কে আমাদের ঘরে ঢুকে আমাদের গুলি করে হত্যা করবে। বন্দুকধারীরা হতে পারে জঙ্গি কিংবা সরকারি সৈন্য। আমাদের ভাবনা আমাদের জীবন।
অবশ্য অপর কাশ্মিরি পণ্ডিত গিরদারি লাল পাণ্ডিত প্রতি বছরের জুলাই মাসে কৌশলে কাশ্মিরে যান। তিনি মধ্য কাশ্মিরে তার গ্রামে এক মাস বসবাস করেন, ফিরে আসেন নীরবে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী লাল তার সন্তান আর নাতি-নাতনিদের সাথে দিল্লিতে বাস করেন।
তিনি বলেন, কাশ্মিরে ফিরে যেতে আমার পরিবারকে রাজি করাতে পারছি না। তারা কেন সেখানে যাবে? আমাদের জন্য সেখানে কী আছে? তার চোখেমুখে ক্রোধ ফুটে ওঠে।
তিনি আরো বলেন, সরকার যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা খুবই সামান্য। আর উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকার কিছুই ভাবছে না।
তিনি এসএএমকে বলেন, আমরা কাশ্মিরি জঙ্গিদের নতুন প্রবণতা দেখছি। চরমপন্থা নতুন মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এখন সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি এখন আর রাজনৈতিক নয়।
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ কাশ্মিরি জঙ্গি নেতা জাকির রাশিদ ভাট ওরফে মুসা (তিনি ছিলেন আল কায়েদার আনসার গুজওয়াট-উল-হিন্দের নেতা) একটি ভিডিও প্রকাশ করে শরিয়া আইন ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
জাকির ভিডিওতে বলেন, কাশ্মিরের অনেক লোক ইসলাম-নিষিদ্ধ জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে নিয়োজিত। কেবল শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর জাকির হয়ে পড়েন জঙ্গিবাহিনীর নতুন মুখ।
জঙ্গিরা পরে পাথর নিক্ষেপকারী তরুণদের প্রতি ‘শরিয়াতিয়া শাহাদাত’ শ্লোগান দেয়ার আহ্বান জানান। পাকিস্তান এই দাবির পক্ষে নয়। এটি জাতি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ওঠা ধ্বনি। তারা একটি ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
জঙ্গিরা ২০১৭ সালের ১০ জুলাই দক্ষিণ কাশ্মিরের অনন্তবাগ জেলায় অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসকে টার্গেট করে। এতে ছয় নারীসহ সাত তীর্থযাত্রী নিহত হয়। এছাড়া আরো ১৯ তীর্থযাত্রী আহত হয়। ২০০০ সালের পর তীর্থযাত্রীদের ওপর এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। ওই বছর তীর্থযাত্রীদের একটি বেইজ ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলায় ২১ জন নিহত হয়েছিল।
প্রতি বছর জুলাই ও আগস্ট মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ৬০ দিনের একটি যাত্রায় অংশ নেয় ৫ লাখের বেশি হিন্দু। একে বলে অমরনাথ যাত্রা। তারা হিন্দুদের ধ্বংসের দেবতা শিবকে পূজা করে।
তীর্থযাত্রীরা সমুদ্র স্তর থেকে ৩,৮০০ মিটার উঁচু অমরনাথ গুহায় যায়। এখানে একটি ৯ ফুট লম্বা শিবের একটি প্রতীক রয়েছে। এটি হিন্দু দেবতাদের মধ্যে অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন।
নয়া দিল্লি ভিত্তিক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ২৩ বছর বয়স্ক অমিত রায়না বলেন, তার মা-বাবা কাশ্মির ত্যাগ করে দিল্লিতে যখন বসবাস করতে যান, তখন তার জন্মও হয়নি। তিনি টেলিভিশনে দেখেছেন কাশ্মিরে বিপুল সবুজ বন, জলাধার, রাজসিক পর্বতমালা। কিন্তু নিজের চোখে দেখেননি।
তিনি বলেন, টেলিভিশনে আমি সহিংসতা, মৃত্যু, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, বন্দুকযুদ্ধও দেখেছি। তাহলে আমি কেন সেখানে যাব?
জঙ্গিদের আত্মপ্রকাশের পর গত ৩০ বছরে জম্মু ও কাশ্মিরে প্রায় এক লাখ লোক মারা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক লোকজন, জঙ্গি, সেনাবাহিনীর সদস্য। পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই কাশ্মির দাবি করছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছে কাশ্মির স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে বিরাজ করছে। পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটি কাশ্মির নিয়ে তিনটি প্রধান যুদ্ধ করেছে।
কাশ্মিরের মধ্যাঞ্চলে হিন্দু মন্দির মাতা খের ভবানীতে পূজা দিচ্ছেন কাশ্মিরি পন্ডিরা, ছবি: উমর আসিফ

No comments

Powered by Blogger.