জীবন যেখানে যেমন by এইচ বি রিতা

সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁ দিয়ে ছাড়তেই একরাশ বিরক্তি চেপে ধরল শুভকে। এই নিয়ে পর পর নয়টা সিগারেট শেষ হলো। জিহ্বাটা তেতো হয়ে আছে। ঘরটা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের মতো ঈষৎ ঘোলাটে দেখাচ্ছে।
ইতিমধ্যে রাহেলা বেগম কয়েক বার দরজায় কড়া নেড়ে গেছেন। শুভ মটকা মেরে না শোনার ভান করে পড়েছিল। যদিও তিনি দরজার নিচ নিয়ে সিগারেটের গন্ধ ঠিকই টের পেয়েছেন।
রাহেলা বেগম মনে করেন, তিনিই এই জগতের সব চেয়ে দুঃখিনী মা। ঘরে জলজ্যান্ত এক কচ্ছপ পুষছেন তিনি। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে যার কাজই হচ্ছে ধীর গতিতে চলা, মাথাটা বাড়িয়ে খাবার খেয়ে আবার সময় মতো মাথাটা শরীরে ঢুকিয়ে ফেলা। দিন রাত ওনার মহান বাণীতে ধমনি কেঁপে উঠে। শরীরের চামড়া তোশকের মতো ভারী বলে তার কোনো বাণীই শুভর গায়ে লাগে না।
যাই হোক, সকালের প্রথম মল ত্যাগ করার ভীষণ তাড়া অনুভব করল শুভ। এক প্রকার জোর করেই উঠে দাঁড়াল সে। স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে দরজা খুলতেই মার মুখোমুখি। মার চোখে চোখ পড়তেই ঘুমে ঢলে পড়ার ভান করে বাথরুমের দিকে ছুটল শুভ।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়—একটা প্রবাদ চালু আছে সমাজে। বাথরুমের দরজায় কড়া নাড়তেই সেই বাঘের হুংকার শোনা গেল। শুভর বাবা তমিজ উদ্দিন চিৎকার করে বললেন, কী সমস্যা? তোর জ্বালায় দেখছি টয়লেটে বসেও শান্তি নেই!
শুভ কিছু না বলে তড়িঘড়ি নিজের রুমে চলে এল। প্রয়োজনে বাঘের মুখে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিসর্জন দিতে রাজি সে। কিন্তু বাবার মুখোমুখি হতে আপত্তি আছে। অগত্যা পেট চেপে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
বালিশের পাশে রাখা মুঠোফোনটার দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল বহ্নির টেক্সট ম্যাসেজ। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল শুভর। এই মেয়েটাকে কীভাবে বলবে যে তার চাকরিটা চলে গেছে! বসের ঘ্যানর ঘ্যানর রোজ অসহ্য লাগে। বহ্নিকে কে বোঝায়! চাকরি ছেড়ে দিয়েছে শোনা মাত্রই ও হুলুস্থুল কাণ্ড করবে। ঝড় যে অঞ্চলেই হোক, বজ্রপাত সময় মতো শুভর মাথাতেই পড়বে।
পেটে এবার রীতিমতো যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। শুভ ভাবছে একবার দেখে আসবে কি বাবার হয়েছে কি না। নাহ! এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না।
ভদ্রলোকের অন্তত ৩০ মিনিটের আগে বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ঘুম ভেঙেই প্রথম আলো পত্রিকার শুরুর পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে তিনি বাথরুমে ঢোকেন। বের হন শেষের পৃষ্ঠা হাতে বিড়বিড় করতে করতে। রোজকার রুটিন। এর চেয়ে বরং আয়েশ করে খাটে পা উঠিয়ে বসে আরেকটি সিগারেট ধরানো যায়।
খাটে আয়েশ করে বসতেই দরজার পাশে ময়নার মা চা হাতে চেঁচিয়ে উঠল। নাকে কাপর চেপে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভাইজান যে কি ছাতা মাতা খান না! এই বলেই চা নামিয়ে রাখল সাইড টেবিলে।
-ময়নার মা…
ময়নার মা চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকাল। বলল, জি ভাইজান
-আমার শার্টটা ধোয়া দরকার।
-দেন ভাইজান, ধুইয়া দিই।
দলা মোচড়া শার্টটা খাটের ওপর থেকে ময়নার মার হাতে দিল শুভ।
-ভাইজান, একটা নতুন শার্ট কিনেন। ধুইতে ধুইতে তো আফনার শার্ট ছিঁড়া যাইতাসে।
বলেই ময়নার মা চলে গেল।
শুভ ভাবল, একটা নতুন শার্ট কিনতে হবে এবার। একই শার্ট পড়ে কতবার যে বহ্নির বিরক্ত মুখ দেখেছে শুভ! শুভ ভাবল, বহু বছর ধরে কামাই করা সার্টিফিকেটের নামে পুরোনো কাগজগুলো যদি কাজে লাগানো যায় এবার, তবে একটা নতুন শার্ট কিনতে হবে। বাবার পুরোনো চশমাটা বদলে নতুন একটা চশমা কিনতে হবে। বহ্নিকে ঘরে তুলতে একটা ভালো চাকরি চাই। বহ্নিকে পেতে ভালোবাসার চেয়ে চাকরিটাই এখন বেশি দরকার। স্বল্প বেতন পাওয়া ছেলের হাতে মেয়ে দিতে রাজি নন হবু শ্বশুর মশাই!
শুভ ভাবছে, অর্থ বিত্তের কাছে বেকার মানুষগুলো কত অসহায়! আচ্ছা, ভালোবাসার পরিমাপ কি একটা ভালো চাকরি দিয়ে করা যায়? সবাই কেন একই নিয়মে কোট-টাই পরে অফিস যাবে বা বড় মাপের ব্যবসায়ী হবে! একই নিয়মে কি পৃথিবী ঘুরছে? ঘুরছে না। ৩৬৫ দিনে কি হামেশাই বছর হয়? প্রতি চার বছর পরপর লিপ ইয়ার এসে পৃথিবীর নিয়ম কি ভেঙে দিচ্ছে না? তাহলে কি অর্থের লড়াই সর্বত্র? কি জানি! হয়তো!
মোবাইল ফোনটা ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। বহ্নির কল। সাইলেন্ট মোডে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল শুভ। এই মুহূর্তে বহ্নি মুখ্য নয়। শরীরের আবর্জনাগুলো ছুড়ে ফেলাই মুখ্য বিষয়।
উফফ! এবার বাথরুমে না গেলেই নয়।

No comments

Powered by Blogger.