প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা: বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসক বা 'জেরিয়াট্রিক কনসালটেন্ট' নেই কেন? by শাহনাজ পারভীন

ঢাকার শ্যাওড়াপাড়ার ষাটোর্ধ জাহানারা বেগমের সাথে যখন কথা হচ্ছিলো, তখন তার মুখে হালকা হাসির রেশ চোখে পড়লো।
কিন্তু একই সাথে চোখে পড়লো তার হাতের হালকা কাঁপুনি।
নিজের শরীরের নানা ধরনের সমস্যার বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন, "আমার হাড়ে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা, এইসব ব্যথা। শরীর কাঁপে, আমি দাড়িয়ে থাকতে পারি না।"
তিনি বলছিলেন বাংলাদেশের আরও অনেক প্রবীণ ব্যক্তির মতো সারাদিন জায়নামাজের উপরেই দিনের লম্বা সময় কেটে যায় তার।
হয়ত একটু টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরানো, পারলে কিছুটা ঘরকন্নার কাজ।
খুব বেশি সময় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মনে হচ্ছিলো এর বেশি হলে তাকে বরং কষ্টই দেয়া হবে।
কিন্তু যে ধরনের শারীরিক সমস্যার কথা তিনি বর্ণনা করছিলেন সেরকম বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসায় বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা বাংলাদেশে একেবারে নেই বললেই চলে।
তেজকুনি পাড়ার বাসিন্দা রিজিয়া বেগম বলছিলেন তার মতো বয়স্কদের পক্ষে আর সবার মতো হাসপাতালে লম্বা সিরিয়ালে বসে থাকা বেশ কষ্টের।
ষাট বছর বয়সের পর মানুষের শরীরে বিভিন্ন অসুস্থতা ধরা পরে
তিনি বলছেন, সাধারণত হাসপাতালগুলোতে অল্পবয়সী ও বয়স্কদের একই ডাক্তার সেবা দিয়ে থাকে।
"অন্যান্য মানুষদের যেরকম দেখে আমাকেও সেরকমই দেখে। বয়স্কদের জন্য আলাদা ডাক্তার থাকলে বেশি ভালো হয়। ভাগ ভাগ করে দিলে আমরা তাড়াতাড়ি যেতে পারি। অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে যাই।"
তার সাথে কথা হচ্ছিলো ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় প্রবীণ হাসপাতালে।
এই হাসপাতালটিতে বিভিন্ন চিকিৎসকদের ঘরের সামনে প্রবীণদেরই প্রাধান্য দেখা গেলো।
দেশের একমাত্র জেরিয়াট্রিক হাসপাতাল এটি। রিজিয়া বেগমের মতো বাংলাদেশে ষাটের উপরে যাদের বয়স তাদের প্রবীণের মর্যাদা দেয়া হয়।
সর্বশেষ ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক কোটি তিরিশ লাখের মতো। এতদিনে তা হয়ত দেড় কোটিতে পৌঁছে গেছে।
জেরিয়াট্রিক কনসালটেন্ট ড. আমিনুল হক বলছিলেন কি কারণে প্রবীণদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন।
তিনি বলছেন, "অল্প বয়সে একজন প্রবীণের যে শারীরিক গঠন ছিল, ক্ষমতা ছিল, সেগুলো পরে আর থাকে না। ষাট বছর বয়সের পর মানুষের শরীরে বিভিন্ন অসুস্থতা ধরা পরে।" 
তেজকুনি পাড়ার বাসিন্দা রিজিয়া বেগম
"এটা শারীরিক ও মানসিক। শারীরিক দিক দিয়ে যেমন দুর্বলতা দেখা দেয়, রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, ক্যান্সার, কিডনির রোগ, আর্থ্রাইটিস এসব ধরা পরে। এখন অল্প বয়সীদের যেভাবে চিকিৎসা করা হয়, বয়স্কদের সেভাবে চিকিৎসা করা যায়না।"
তিনি বলছেন বয়সের কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতা কমে যায়।
সেসব মাথায় রেখে তার চিকিৎসা দিতে হয়। তার ঔষধের ধরন ও মাত্রা অন্যরকম হবে।
অনেক বয়স্ক রোগীর ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে।
নিজের ঔষধের সময় ও মাত্রা হয়ত ঠিকভাবে মনেই রাখতে পারবে না তারা।
অনেকে নিজের মল-মূত্রের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
ডা. হক বলছেন একারণেই তাদের আলাদা সেবা দরকার।
ড. হক জেরিয়াট্রিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন বাংলাদেশে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবায় জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনার কোন ধরনের ব্যবস্থাই নেই।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যন্ত এই বিষয়ে আলাদা ইউনিট নেই।
জেরিয়াট্রিক কনসালটেন্ট ড. আমিনুল হক বলছেন বয়সের কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতা কমে যায়।
সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল খুব ছোট পরিসরে জেরিয়াট্রিক সেবা শুরু করেছে।
অনেক সময় বয়স্কদের সেবা দিতে পরিবারের লোকেরাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
প্রবীণ হাসপাতালে গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. লায়লা সাবেকুন নাহার বলছেন জেরিয়াট্রিক সেবার অভাবে বয়স্ক নারীরা আরও বেশি সমস্যায় পরেন।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে সাধারণত অল্প বয়সে নারীদের বিয়ে হয়। বাচ্চা নিতে হয়, বাচ্চা পালতে হয়, সংসারটা নারীদের উপরেই থাকে।"
"দেখা যায়, তারা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না, নিজেদের খেয়াল করে না। যখন মেনোপজ হয় তখন মহিলারা অনেক ভুগতে থাকে। বেশিরভাগ মহিলাদের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি'র ঘাটতি দেখছি আমি।"
মিজ. সাবেকুন নাহারের মতে অনেক বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার কারণেও বয়স্ক নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় বেশি ভোগেন।
তারা ওভারি ও জরায়ুর নানা সমস্যা নিয়ে আসেন।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর হিসেবে ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি হয়ে যাবে।
ডা. লায়লা সাবেকুন নাহার বলছেন জেরিয়াট্রিক সেবার অভাবে বয়স্ক নারীরা আরও বেশি সমস্যায় পরেন।
আর ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবীণদের জনসংখ্যা অপ্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণদের ছাড়িয়ে যাবে।
প্রবীণদের সেবায় বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন, প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান বলছেন, প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবায় এখনই বিনিয়োগ না করলে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপদে পড়বে।
তার মতে, "আমরা বিপদে পরবো এই কারণে যে বর্তমানে যে দেড় কোটি প্রবীণ, তারা আসলে দেড়কোটি রোগী।"
"ইউএনএফপিএ বলছে ২০৫০ সালে সাড়ে চার কোটি হয়ে যাবে। প্রবীণ বাড়ছে মানে রোগী বাড়ছে। জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের জন্য আমাদের ডিগ্রি, কোর্স, হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা, দীর্ঘমেয়াদী সেবা, শেষ সময়ের সেবা এসব চালু করা প্রয়োজন।"
সর্বশেষ নির্বাচনে বর্তমান সরকারের একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ষাটোর্ধদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সরকারি হাসপাতালগুলো সহ আলাদা জেরিয়াট্রিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠার চিন্তা কতটা রয়েছে?
তিনি বলছেন, "এটা ঠিক যে হাসপাতালগুলোতে এই বিষয়ে আলাদা জেরিয়াট্রিক ইউনিট নেই। আমরা আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো থেকেই শুরু করতে পারি।"
হাসপাতালগুলোতে ষাট বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, দেখা যাবে শতকরা তিরিশ বা চল্লিশ ভাগ রোগীই এই বয়সী। আমরা ভাবছি তাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করবো, তাদের জন্য আলাদা আউটডোরের ব্যবস্থা করবো।"
জেরিয়াট্রিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিষয়ে আলাদা পড়াশোনা ও এই বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তৈরিও জরুরী।
মেডিকেল কলেজগুলোতে এই বিষয়ে আলাদা ডিগ্রি তৈরি করাও জরুরী। কিন্তু সেটি সহসাই সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে।
ডা. আজাদ বলছেন আপাতত এখন হাসপাতালে ডাক্তার নার্স যারা রয়েছেন তাদের আলাদা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
কিন্তু সবমিলিয়ে পরিস্থিতির বিবেচনায় মনে হচ্ছে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবায় আরও বহুদূর যেতে হবে বাংলাদেশকে।
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান বলছেন, প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবায় এখনই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.