শ্রীলংকা: ইস্টার সানডে থেকে বেসাক – একটি ব্যক্তিগত আখ্যান by এস বিক্রেমারত্নে

২০ এপ্রিল ২০১৯ আমি সামনের সপ্তাহ নিয়ে ভাবছিলাম – জীবনের পরিকল্পনা এবং সাপ্তাহিক চাহিদার হিসাব নিকাশ করছিলাম। চারদিকে সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক।
২১ এপ্রিল, ২০১৯, রোববার আমি জেগে উঠলাম চরম উদ্বেগের মধ্যে। এরপরও সকাল ৯টার দিকে ঘর থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা নিলাম আমি। হঠাৎ বাবার একটা চিৎকারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি “একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে”। আমার মুখ হা হয়ে গেলো, ‘কি’?
১৯ বছর ধরে এই শব্দগুলোর সাথে যোগাযোগ নেই আমার। দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে গৃহযুদ্ধ দেখতে হয়নি আমাকে, কিন্তু কলম্বোতে আমার ছেলেবেলায় এই শব্দগুলো অনেক শুনেছি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনার সত্যতা জানতে পারলাম। পুরো শ্রীলংকা জুড়ে একটা আঘাত আর যাতনা বয়ে যাচ্ছে এবং আশার আলোটা ক্রমেই কমে আসছে। যন্ত্রণাদায়ক দেশপ্রেমের মধ্যে, একটা চিন্তারই পুনরাবৃত্তি করলাম আমরা: “প্লিজ, নট এগেইন”।
আধা ঘন্টার মধ্যে আমাদেরকে গৃহযুদ্ধের সময়ে ফিরে যেতে বাধ্য করা হলো, পরিস্থিতি অবশ্য গৃহযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ ছিল। শয়তানী শক্তির কাছে কলম্বো এক দিনেই ছয়বার নত হলো। একটা বিস্ফোরণ স্থল ছিল আমার কর্মক্ষেত্র থেকে মাত্র ১০ মিটার দূরে।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবিশ্বাস, যন্ত্রণা আর গৃহযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণে নিয়ে আমি পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী আর সাহায্যকারীদের খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তারা জীবিত আছেন। আমার পরিচিতরা ‘জীবিত’ আছেন – কিন্তু আমার কাছে এটা অবাস্তব আর ভঙ্গুর মনে হলো।
আমি মানসিক আঘাত আর উদ্বেগ নিয়ে অস্থির থাকলাম, আমার পরিবারের লোকেরা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে থাকলো। কিন্তু আমি দেখতে পারলাম না। ২২ মিলিয়ন শ্রীলংকানের উপর – আমাদের জীবন, আমাদের স্বাভাবিকতা, আমাদের আশার উপর যে অসহায়ত্ব আর যাতনা আরোপিত হয়েছে, সেটাকে আমি মেনে নিতে পারলাম না।
কারফিউ জারি হলো, রাত নামলো, শেষ পর্যন্ত টেলিভিশনে সারা দিনের বর্বরতার দৃশ্য দেখলাম। যন্ত্রণায় চোখে পানি আসলো, হাঁটু কাঁপতে লাগলো। আমার জন্মস্থান কলম্বো বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। নিষ্পাপ মানুষ মারা গেছে – যাদের মধ্যে শিশুও আছে, যাদের এমনকি বিভাজন সম্পর্কে ধারণাও নেই, তারাও মারা গেছে। বহু পরিবারের অস্তিত্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই মুছে গেছে। সেন্ট অ্যান্থনি চার্চ, সিনামন গ্র্যান্ড, সাংগ্রি-লা, এবং কিংসবেরি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এইসব জায়গার আনন্দময় স্মৃতিগুলো রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কলম্বোর শোককে সান্ত্বনা দেয়ার কোন উপায় নেই।
পরদিন শ্রীলংকা জেগে উঠলো থমকে থমকে, আতঙ্ক আর শোকের মধ্যে। স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে, ২৩ এপ্রিলের কালো আকাশের নিচে আতঙ্কের মধ্যে মৃতদের কবর দিয়েছি আমরা।
এক সপ্তাহ আমরা চরম উদ্বেগের মধ্যে কাটিয়েছি, ঘরে বন্দী থেকেছি, নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন দিশা খুঁজে পায়নি। হাসপাতালগুলো খালি হয়ে গিয়েছিল কারণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করেছিলেন ডাক্তাররা। আমার উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছিল কারণ আমার বাবার জরুরি মেডিকেল কেয়ারের প্রয়োজন পড়েছিল। একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি তাকে সঙ্গ দিতে পারিনি। আমাকে সংবাদের পিছনে ছুটতে হয়েছে, আরও বিস্ফোরণ ঘটলো কি না, সেটা খুঁজতে হয়েছে, কারা মারা গেলো তাদের পরিচয় খুঁজতে হয়েছে। তাই, আমার বাবাকে সম্ভাব্য সমস্যার মধ্যে ফেলেই আমাকে ছুটতে হয়েছে, আমি জানতামও না তিনি ফিরে আসবেন কি না।
ইস্টার সানডের বোমা হামলার পর চার সপ্তাহ ধরে আতঙ্ক আর আস্থার দোলাচলের মধ্যে আছে শ্রীলংকা। জীবন বদলে গেছে। প্রাণবন্ত আর চটকদার কলম্বো প্রচণ্ড নিরব হয়ে গেছে। প্রার্থনার জায়গাগুলো হঠাৎ করেই থেমে গেছে। সরকারের ব্যাপারে জোরেসোরে এবং তীব্র ভাষায় সমালোচনা চলছে। অস্থিরতার ভেতরের স্রোতটা থেমেছে, এরপর আবারও নিরপরাধ ব্যক্তিরা হামলার শিকার হয়েছে। আতঙ্ক ও যন্ত্রণা আবারও ঘিরে ধরেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থমকে গেছে। কর্মস্থলগুলোতে নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে দুর্গ বানিয়ে তোলা হয়েছে।
কিন্তু দয়া এবং ঐক্যের বহিপ্রকাশের কারণে নতুন আশার জন্ম নিয়েছে। বৌদ্ধ ও ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন ঘন ঘন জিজ্ঞাসা করা হযেছে, যেখানে একজন মাত্র কার্ডিনাল (সব ধর্মের লোক যাকে সমর্থন দিয়েছে) বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু একটা জাতির মধ্যে ঐকতান নিয়ে এসেছেন।
নতুন এই নীতির মধ্যে প্রত্যেকে নিরাপত্তা, আশা, ভালোবাসা, ঘৃণা, শৃঙ্খলা ও আস্থা – প্রত্যেকেই যারা নিজ নিজ গল্পের কাঠামোয় গভীর হতাশায় নিমজ্জিত – প্রত্যেকেই তারা এই গভীর উত্তরহীন প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন।
এইসব চিন্তা, বিনিময় এবং সম্ভাব্য অনৈক্যের মধ্যে একটা বিষয় বোঝা গেছে, শ্রীলংকা যে নাগরিক তৈরি করছে, তাদের মানের দিকে নজর দিতে হবে, সমস্ত নাগরিককে ক্ষতিমুক্ত দেশপ্রেম, সমন্বয়, সহিষ্ণুতা, দয়া, সমবেদনা, এবং সততায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এই ধারণাগুলোকে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ও বারবার পুণরাবৃত্তি করতে হবে, যাতে সম্মিলিতভাবে আমরা কোমলমতি মানুষ তৈরি করতে পারি – এমন মানুষ যারা শ্রীলংকাকে এর ট্রপিক্যাল সৌন্দর্য, এর সংস্কৃতি ও বৈচিত্রের জন্য ভালোবাসবে।
গত মাসের যন্ত্রণা আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে আধ্যাত্মিকতা – শুরুটা হয়েছে ইস্টার সানডে দিয়ে, যেদিন যীশু খ্রিস্ট আসমানে উঠে যান – সেটা দিয়ে, এরপর এসেছে রমজান, আর শেষ হয়েছে বেসাক দিয়ে – যে দিনটিতে বুদ্ধর জন্ম, বোধিপ্রাপ্তি এবং নির্বাণ লাভ হয়েছে।
এটাকে সম্ভবত কাকতালীয় বলা যাবে না, বরং শ্রীলংকা এবং বিশ্ব নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এটাকে একটা বৈশ্বিক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়, যেখানে প্রতিটি ধর্মের মধ্যে যে কোলমতা এবং সহিষ্ণুতা রয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষার দিকে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ফুটে উঠেছে।
“সমগ্র বিশ্বে – উপরে নিচে ও চারিদিকে – নিরঙ্কুশ, বিদ্বেষহীন, শত্রুতমুক্ত – সীমাহীন প্রেম ছড়িয়ে দাও।”- বুদ্ধ। (মেত্তা সুত্তা থেকে)

No comments

Powered by Blogger.