তাজমহলের প্রতি বাংলাদেশের ভালোবাসা থেকে শিক্ষা নিতে পারে নব্য মোগলবিদ্বেষী ভারত

২০০৮ সালের শেষ দিকে পুরো বাংলাদেশে খবর ছড়িয়ে পড়ে, তাজমহালের প্রমাণ আকারের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে ঢাকার উপকণ্ঠে। এ নিয়ে ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মকর্তারা তীব্র ও কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশীরা বিপুলভাবে উদ্দীপ্ত হয়। এই সাহসী উদ্যোগের পেছনে ছিলেন ঢালিউডের বর্ণিল প্রডিউসার আহসানুল্লাহ মনি। মূল আকার নিখুঁতভাবে গ্রহণের জন্য তিনি আগ্রায় আর্কিটেকদের পাঠিয়েছিলেন, ইতালি থেকে মার্বেল, বেলজিয়াম থেকে রত্মপাথর আমদানি করেন। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে বিনিয়োগ করা হয় ৫৮ মিলিয়ন ডলার।
নারায়ণগঞ্জে নির্মিত বাংলার তাজমহলটি অবশেষে খুলে দেওয়া হয় ২০০৯ সালের ঈদের ঠিক আগে দিয়ে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। মূল আকারে বিচ্যুতি, রঙের বাহুল্য প্রয়োগ ও প্রশ্নবোধক অভিনব নক্সার কারণে এটি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
স্থানীয় এক ব্লগার প্রথম পর্যটকদের হতাশা প্রতিফলিত করে বলেন, “তাজমহলটি দেখে আমার মুখ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কথা বের হলো তা হলো: ‘শালা, শালা।’”
হিন্দি ছবির নিম্নমানের নকলের জন্য কুখ্যাতি (এখন মোগল স্থাপনার জন্যও) অর্জনকারী মনি বলেন, এই বিনিয়োগ আসলে তার দান-খয়রাত।  তিনি বলেন, প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখে তাজমহল দেখার। কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ায় খুব কম বাংলাদেশীই তা দেখতে পারে।
ঢাকার কাছে তাজমহলের আদলে তৈরি স্থাপনা একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ
তার ঘোষণা অনুযায়ী গণমানুষের জন্য ‘ভালোবাসার তাজমহল’ নির্মাণ করেছেন তিনি। লাজুক প্রেমিক-প্রেমিকা ও পরিবারগুলোর জন্য এটি একটি বেশ ভালো জায়গা। অনেকেই সেখানে গিয়ে সেলফি তোলেন, সস্তা দরের তাজমহল-সংশ্লিষ্ট চীনা পণ্য কেনেন, কাছাকাছি থাকা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খানাপিনা করেন। স্থানটিতে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক বা এমনকি শৈল্পিক ছোঁয়া নেই।
প্রবেশের টিকেটের দাম অনেক বেশি (১০০ টাকা, ভারতের মূল তাজমহলে প্রবেশ করতে লাগে ৪০ রুপির টিকেট) হওয়া সত্ত্বেও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কাছে এখনো এটি জনপ্রিয় স্থান। এর কারণ হলো বিশ্বের অত্যশ্চার্য স্থানগুলোর একটি তারা বাংলাদেশেই পাচ্ছে।
স্থাপনাটির চিত্র বাংলাদেশের রিকশা আর্টের অন্যতম জনপ্রিয় বিষয়। অসংখ্য রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারের নাম এর নামে রাখা হয়েছে। সরকারি অফিস আদালতগুলোতেও এর মার্বেল গম্বুজ দেখা যায়। সরকারি মগ, ক্যালেন্ডারেও দেখা যায় তাজমহল।
অতীতের সাথে সম্পর্ক
সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানেও জাতীয় পরিচিতি-সংশ্লিষ্ট বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাজমহল। পাকিস্তানের জনগণ মনে করে মোগল সাম্রাজ্যের সহজাত উত্তরাধিকারী হিসেবে তারাই তাজমহলের ওপর নৈতিক অধিকার রাখে।
ঐতিহাসিকভাবে প্রশ্নবোধকতা ছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই পাকিস্তানকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা বাংলাদেশের জন্য কিছুটা অপমানজনক। পূর্ব বাংলাও ছিল মোগল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৬০৮ সালে ঢাকা (তখন পরিচিতি ছিল জাহাঙ্গীরনগর হিসেবে) হয় বাংলা প্রদেশের রাজধানী। কলকাতা তখন ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর শহর। এ কারণেই বাংলাদেশে এখনো মোগল স্থাপনা দেখা যায়। এর উদারণ হলো ঢাকার লালবাগ দুর্গ ও সাত গম্বুজ মসজিদ।  অবশ্য সার্বিকভাবে মোগল স্মারক দুর্লভ ও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
ঢাকার কাছে তাজমহলের আদলে তৈরি স্থাপনা একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ
এই তুলনামূলক শূন্যতার আলোকে অনুমান করা চলে, তাজমহলের সৌন্দর্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে (অন্তত চেষ্টা করে হলেও) বাংলাদেশীরা পরাক্রমশালী মোগল গাঁথায় তাদের ভূমিকা পালন করে চলেছে। অধিকন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে সত্যিকারের তাজমহলের ধর্মীয় দ্যোতনাও আছে। এটি কেবল মুসলিম শাসক নির্মাণ করেছেন বলেই নয়, এখানে এখনো নামাজ হয়।
অবশ্য বাংলাদেশীদের মধ্যে তাজমহলের প্রতি আকর্ষণ মোটামুটিভাবে ধর্মীয় নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ সরকার কেন তার সরকারি মগে তাজমহলের ছবি রাখে, এ প্রশ্নের জবাবে এক সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ও ওই মগের গর্বিত মালিক বলেন, ‘খুব সম্ভবত, এটি সুন্দর দেখায় বলে।’
গত বছর বাংলার তাজমহল পরিদর্শনের সময় আরো বেশি আনন্দ লাগল একই ধরনের আকারে মিসরীয় পিরামিডও সেখানে দেখে। মিসরীয় দূতাবাস দৃশ্যত কপিরাইট লঙ্ঘন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।
তাজমহল রেপ্লিকার সামনে বিক্রি হচ্ছে স্যুভেনির

No comments

Powered by Blogger.